Site icon Doinik Bangla News

আগেভাগেই মাঠ দখলের পরিকল্পনা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আগেভাগে প্রার্থী ঠিক করে আগেই মাঠ দখলের পরিকল্পনা করছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত তাঁরা সম্ভাব্য প্রার্থীই থাকবেন। তফসিলের পর আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। যেসব আসনে জোটের শরিকদের চাহিদা আছে, সেখানে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে না। এ ছাড়া যেখানে জরিপে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে জনপ্রিয়তার পার্থক্য কম, সেগুলোতে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে।

তিনটি বিষয় মাথায় রেখে আওয়ামী লীগ আগাম প্রার্থী ঠিক করে তাঁদের মাঠে নামানোর পরিকল্পনার করছে বলে জানা গেছে। তা হলো এক. বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত রেখে আগেভাগে মাঠ দখল এবং ভোটারদের কাছে বেশি করে পৌঁছানোর সুযোগ নেওয়া। দুই. এতে অভ্যন্তরীণ বিরোধ থাকলে সেটা মিটিয়ে সর্বাত্মক প্রচার চালানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। তিন. শেষ মুহূর্তে প্রার্থী ঘোষণা করা হলে ভুল শোধরানোর সুযোগ থাকে না।

তবে টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে সারা দেশে সরকারি দলে যে কোন্দল রয়েছে, তাতে আগে থেকে কাউকে সবুজসংকেত দিলে অন্যরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারেন বা বিরোধিতায় নেমে পড়তে পারেন—এমন আশঙ্কাও দলের নেতাদের আছে।

আওয়ামী লীগের তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগেভাগে প্রার্থীদের অনানুষ্ঠানিকভাবে সবুজসংকেত দেওয়ার বিষয়ে গত শনিবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতি-মণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য। এ জন্য সব কৌশলই নেওয়া হবে। আগেভাগে প্রার্থী ঠিক করে রাখতে পারলে প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হবে—এমন চিন্তাভাবনা দলে আছে।

২০০ আসনে সর্বশক্তি

আওয়ামী লীগের আরেকটি পরিকল্পনা হচ্ছে, সব আসনে জোর না দিয়ে ২০০ আসনে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। দলটির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে সরকার গঠন করার জন্য ১৫১ আসনই যথেষ্ট। সুতরাং ৩০০ আসনের পেছনে না দৌড়ে ২০০ আসনে ভালো প্রার্থী বাছাই করে এর পেছনে অর্থ, রাজনৈতিক শক্তি এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে অর্জিত প্রশাসনিক সুবিধা কাজে লাগাতে হবে। বাকি ১০০ আসন জোট-মহাজোটের জন্য বিবেচনা করা।

তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে এখনো জোটে আলোচনা শুরু হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনী কৌশল বা আসন বণ্টন নিয়ে জোটে এখনো আলোচনা শুরু না হলেও শরিকেরা যার যার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে আসন বণ্টনের কাজটা আগেভাগে করে ফেলা ভালো।

বিবেচনায় জরিপের ফল

সরকার ও আওয়ামী লীগের সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অনেক দিন ধরেই সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ও দলীয়ভাবে নানা জরিপ চালানো হচ্ছে। এসব জরিপের ফল নিয়ে দলীয় ফোরামে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে নেতারা অল্পস্বল্প যা জানছেন, তাতে জরিপের ফল খুব আশাবাদী হওয়ার মতো নয় বলে অনেকের ধারণা।

অবশ্য গত ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে তিনি জরিপ করেছেন। জরিপের ফল এত ভালো এসেছে যে ভোট হলে ২০০৮ সালের চেয়েও বেশি ভোট পাবে আওয়ামী লীগ।

গত এক বছরে যে তিনটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে কেবল নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। কুমিল্লায় বিএনপি ও রংপুরে জাতীয় পার্টি জয়ী হয়। এই ফলাফলকেও জনপ্রিয়তার একটা মাপকাঠি মনে করেন অনেক নেতা। শনিবারের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, বাংলাদেশে টানা তিনবার জয়ী হওয়া কঠিন। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব। এ জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

জেলা পর্যায়ে নির্বাচনী সফর

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, দলীয় কোন্দল নিরসন ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিজয়ী করার লক্ষ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের নেতৃত্বে ১২টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি দলকে কাছাকাছি কয়েকটি জেলা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে তারা জেলায় জেলায় সফর শুরু করবে। এরপর উপজেলা পর্যায়ে যাবে। সরকারের চার বছর পূর্তির দিন ১২ জানুয়ারি থেকেই এই সফর শুরু হচ্ছে। চলবে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভাগীয় শহরগুলোতে সফর শুরু করবেন ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে। শুরুতেই তিনি বরিশাল, সিলেট ও রংপুর যাবেন। এ বিষয়গুলো শনিবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয়।

বৈঠকে ছিলেন এমন একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ছয় মাস অন্তর প্রতিটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে জরিপ করছেন। ১২টি দলকে সাংগঠনিক সফরে গিয়ে প্রচারের পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তা লিখিতভাবে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব জরিপ সমন্বয় করেই প্রার্থীদের আগেভাগে মাঠে নামার নির্দেশনা দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে জরিপ চলছে। তৃণমূল থেকেও নাম চাওয়া হবে। প্রার্থী বাছাইয়ের কাজটা আগে থেকে শুরু করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন এলে অনেক প্রার্থী নেমে টাকা খরচ করা শুরু করেন। এতে নেতা-কর্মীরাও নানা লোকের পেছনে ছুটতে থাকেন। একটু আগে প্রার্থী ঠিক করে দেওয়া হলে তাঁকে নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়।

বেশির ভাগ আসনে একাধিক প্রার্থী

আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্য ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতার আসন বাদ দিলে বেশির ভাগ আসনেই আওয়ামী লীগে ৩ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত আগ্রহী প্রার্থী রয়েছেন। বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদেরা নতুন প্রার্থীদের নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখছেন। আর নতুন প্রার্থীরাও মন্ত্রী-সাংসদের বিষয়ে ব্যাপক বদনাম ছড়াচ্ছেন। সাধারণত প্রতিপক্ষ দল নির্বাচনের আগে এসব অপপ্রচার ও বদনাম ছড়িয়ে থাকে। এ জন্যই আগাম প্রার্থী ঘোষণা করে দ্বন্দ্ব-কোন্দল থাকলে তা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা এবং মাঠ দখলের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেউ মন্ত্রী-সাংসদকে দেখতে না পারলে প্রকাশ্যে বলে বেড়ান যে সুষ্ঠু ভোট হলে ওই প্রার্থীর জেতার কোনো সুযোগই নেই। অর্থাৎ নিজ দলের মন্ত্রী-সাংসদের অবস্থা খারাপ। আর সুষ্ঠু ভোট হবে না—এমন একটা প্রচার পেয়ে যাচ্ছে।

দলের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, টানা নয় বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে বর্তমান মন্ত্রী-সাংসদদের ব্যাপারে ভোটার ও দলীয় নেতা-কর্মীদের অনেক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এ জন্য অনেক আসনে নতুন প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শনিবারের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাও সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।

Exit mobile version