Site icon Doinik Bangla News

ইসলামে বিয়ের বিধান

পূরণ করাই ইসলামি শরিয়তের বিধান। এ জন্য সৃষ্টি হয়েছে বিয়ে নামক বিধানের।

আল্লাহ তাআলা প্রথম মানব ও প্রথম নবী হজরত আদম (আ.)–কে সৃষ্টি করার পর তিনি একাকিত্ব অনুভব করলেন। আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর এই একাকিত্ব দূর করার জন্য মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর সঙ্গী হিসেবে আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ.)–কে সৃষ্টি করলেন। এখান থেকেই শুরু নারী ও পুরুষের দাম্পত্য জীইসলাম হলো মানবকল্যাণের ধর্ম। মানবের জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণই ইসলামের উদ্দেশ্য। মানুষের সব প্রাকৃতিক ও সামাজিক চাহিদা সহজ, সুন্দর, মার্জিত ও পরিশীলিত উপায়ে বনের। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহাপরিকল্পনায় বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) দুনিয়ায় এলেন। তাঁদেরই ঔরসজাত সন্তানেরাই পৃথিবী সাজিয়েছে। আর সেই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এই বিয়ের রীতি।

নারী ও পুরুষের যুগলবন্দী হওয়ার পদ্ধতিকে বাংলা পরিভাষায় ‘বিবাহ’ বা ‘বিয়ে’ বলা হয়। আরবিতে বলা হয় ‘নিকাহ’। বিয়ে সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আক্দ’। প্রস্তাব, গ্রহণ, সাক্ষী ও দেনমোহর হলো ‘আক্দ’ সম্পন্ন হওয়ার মৌল তিন উপকরণ। এর লিখিত রূপ হলো ‘কাবিন’। অনেক সময় কাবিনে উল্লিখিত বা নির্ধারিত দেনমোহরকেও ‘কাবিন’ বলা হয়ে থাকে। কখনো দেনমোহর অনির্ধারিত বা ঊহ্য থাকলে ‘মোহরে মিছল’ বা ‘সমমান মোহর’ বর্তাবে। ‘মোহরে মিছল’ বা ‘সমমান মোহর’ হলো, অন্য কোনো মেয়েকে দেওয়া সমমানের মোহর।

‘মোহর’ হলো বিয়ের সময় বর কর্তৃক কনেকে প্রদত্ত সম্মানী; যার মাধ্যমে তিনি স্বামীর অধিকার লাভ করেন। মোহর নগদে প্রদান করা উচিত। উভয় পক্ষের সম্মতিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ বাকিও থাকতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। জীবনে পরিশোধ না করলে মৃত্যুর পর ঋণ হিসেবেও সম্পদ বণ্টনের আগে পরিশোধ করতে হবে।

বিয়ে বিধিবদ্ধভাবে রেজিস্ট্রি হওয়া আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। এতে পূর্বাপর অনেক অহেতুক ঝামেলা থেকে মুক্ত
থাকা যায়। যেমন স্বামী বা স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত করা, সন্তানের দায়দায়িত্ব ও ভরণপোষণ ইত্যাদি।

আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমে বলেন: ‘তিনিই সেই সত্তা! যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি হতে; অতঃপর তিনি তার বংশীয় সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন। আর তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান।’ (সুরা: ফুরকান)। ‘এবং তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য হতে জোড়া সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকটে শান্তি পাও; এবং তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা: রুম)।

ইসলাম-পূর্ব যুগে গোত্রপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, বংশপ্রীতি ছিল অত্যন্ত প্রকট। তারা নিজ নিজ গোত্র, আপন আপন গোষ্ঠী ও নিজ নিজ বংশে বৈবাহিক সম্পর্ক সীমাবদ্ধ রাখত। ফলে একান্ত নিকটজনদের সঙ্গেও বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতি চালু ছিল।

ইসলাম মানবতাবোধ ও চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। তাই বৃহত্তর পরিমণ্ডল সৃষ্টি ও সংকীর্ণতা দূর করা এবং মানুষে মানুষে সখ্য, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য তৈরির লক্ষ্যে বিশেষ কিছু বিধান দেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় একান্ত আপনজনদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয়স্বজন সব সময় আপন; এখন প্রয়োজন এই সম্পর্কের বাইরের লোকদের আপন করা; বিভিন্ন গোত্র, গোষ্ঠী ও বংশের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করা। তাই একান্ত আপনজনদের সঙ্গে বিবাহবন্ধন নিষিদ্ধ হলো। সব বোন বা একাধিক বোন এক পুরুষে সমর্পণ নিষিদ্ধ হলো। সব ভাইয়ের বা একাধিক ভাইয়ের এক কনে গ্রহণও নিষিদ্ধ হলো। নিষিদ্ধ হলো পিতার বিবাহিতা এবং সন্তানের বিবাহিতা নারীও।

আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারিমে ঘোষণা করেছেন: ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা (দাদি, নানি ও ঊর্ধ্বতন), কন্যা (ও অধস্তন), বোন (ও অধস্তন), ফুফু, খালা, ভাতিজি (ও অধস্তন), ভাগনি (ও অধস্তন), দুধমা (দাদি, নানি ও ঊর্ধ্বতন), দুধবোন (ও অধস্তন), শাশুড়ি (দাদিশাশুড়ি, নানিশাশুড়ি ও ঊর্ধ্বতন) এবং তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের সহিত সংগত হয়েছ তার অন্য পক্ষের (পূর্ব বা পরের স্বামীর) ঔরসজাত ও তার গর্ভজাত কন্যা (ও অধস্তন)। তোমাদের জন্য আরও নিষিদ্ধ করা হয়েছে তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী (ও অধস্তন) এবং দুই বোনকে (বিয়ের মাধ্যমে) একত্র করা; পূর্বে যা ঘটেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা: নিসা)।

যাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ বা হারাম, তাদের বলা হয় ‘মাহরাম’। মাহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো সম্মানিত ও নিষিদ্ধ। ‘মাহরাম’ শব্দটি পুরুষবাচক, এর স্ত্রীবাচক শব্দ হলো ‘মাহরামাহ’। একজন পুরুষের জন্য ‘মাহরামাহ’ হলেন চৌদ্দ প্রকার নারী এবং একজন নারীর ক্ষেত্রে ‘মাহরাম’ হলেন চৌদ্দ প্রকার পুরুষ।

নারীর জন্য মাহরাম চৌদ্দ পুরুষ হলেন: পিতা (এবং দাদা, নানা ও ঊর্ধ্বতন), পুত্র (ও অধস্তন), ভাই (এবং সৎভাই তথা বৈমাত্রেয় বা বৈপিতৃয় ভাই ও অধস্তন), চাচা (ও সৎচাচা তথা দাদার অন্য পক্ষের সন্তান বা দাদির অন্য পক্ষের সন্তান), মামা (ও সৎমামা তথা নানার অন্য পক্ষের সন্তান বা নানির অন্য পক্ষের সন্তান), ভাতিজা (ভাই, সৎভাই ও দুধভাইয়ের সন্তান ও অধস্তন), ভাগনি (বোন, সৎবোন ও দুধবোনের সন্তান ও অধস্তন), দুধপিতা (এবং দুধদাদা, দুধনানা ও ঊর্ধ্বতন), দুধভাই (ও অধস্তন), শ্বশুর (এবং দাদাশ্বশুর, নানাশ্বশুর ও ঊর্ধ্বতন), সৎপুত্র তথা স্বামীর ঔরসজাত অন্য পক্ষের পুত্র বা স্বামীর অন্য স্ত্রীর পুত্র (ও অধস্তন), সৎবাবা (এবং সৎদাদা, সৎনানা ও ঊর্ধ্বতন)। একত্রে একাধিক স্বামী গ্রহণ করা হারাম এবং বিবাহবিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যুর পর ‘ইদ্দত’ (তিন মাস বা চার মাস দশ দিন) পূর্ণ হওয়ার আগে অন্য স্বামী গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Exit mobile version