Site icon Doinik Bangla News

কুমিল্লায় এলাকা ভিত্তিক বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

ক্রাইম রিপোর্টঃ কিশোর গ্যাং’ এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কুমিল্লা জেলাজুড়ে পাড়া মহল্লায়।  কোনো অবস্থাতেই এসব গ্যাংয়ের অপরাধ রোধ করা যাচ্ছে না। কথিত কিশোর গ্যাংয়ের আছে ছুরি, চাপাতি, ড্রাগার, সুইচ গিয়ার, চাকু, এনটিকাটার, রামদা, হকিস্টিক ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্র। গ্যাংয়ের এসব কিশোর এলাকায় মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, মাস্তানি, চাঁদাবাজি এমনকি এলাকা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে তুচ্ছ বিষয়ে খুনের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। একেকটি ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসলেও কিছুদিন না যেতে ফের আগের অবস্থায় চলে যায়। সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে নগরীর পাড়া-মহল্লায়। সর্বশেষ গত শুক্রবার কুমিল্লা শহরের নগর উদ্যানের পাশের সড়কে শাহাদাত হোসেন নামে এক কিশোরকে সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করেছে।

এ ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে গ্যাংয়ের ছয় জন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতারসহ অস্ত্র উদ্ধার করেছে র‍্যাব। তারা ‘রতন গ্রুপ’-এর সদস্য বলে র‍্যাব জানিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। পরনে টি-শার্ট, জিনস প্যান্ট আর চোখে সানগ্লাস। চুলে জেল লাগানো নিত্য নতুন স্টাইল। অলিগলি, পাড়া-মহল্লা, রাস্তার মোড় ও ফুটপাতে তারা জমিয়ে আড্ডা দেয়। উচ্চস্বরে গান করে। কোনো বয়স বিবেচনা ছাড়াই যুবতি-তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে। রাস্তায় দামি মোটরসাইকেল ও কার রেসিং চলে। এলাকা ভেদে এদের রয়েছে নানা নামে পৃথক ‘গ্যাং’ বা গ্রুপ। ‘আরজিএস’, ‘রতন গ্রুপ’, ‘ঈগল গ্রুপ’সহ এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন নামের এসব গ্রুপের কিশোররা গোটা নগরী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তুচ্ছ বিষয়ে খুনের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। গত শুক্রবার বিকালে কুমিল্লা শহরের নগর উদ্যানের পাশের ব্যস্ততম সড়কে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নগরীর পুরাতন চৌধুরীপাড়া এলাকার শাহ আলম ভূঁইয়ার ছেলে শাহাদাত হোসেনকে (১৭)। এ ঘটনার পরদিন শনিবার রাতে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা হয়।

ঘটনার পর র‍্যাব-১১, সিপিসি-২ কুমিল্লার একটি টিম ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে বিভিন্ন স্থান থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করে। র‍্যাব-১১, সিপিসি-২ কুমিল্লার অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন রবিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান, নিহত শাহাদাত ‘ঈগল গ্রুপে’র সদস্য ছিল। গত ছয়-সাত মাস আগে ‘ঈগল গ্রুপে’র সদস্যরা ‘রতন গ্রুপে’র এক জন সদস্যকে মারধর করে। এ ঘটনার জেরে ‘রতন গ্রুপে’র রতনের নেতৃত্বে গ্যাংয়ের সদস্যরা শাহাদাতকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় নগরীর মফিজাবাদ কলোনির রতন গ্রুপের রতন এবং গ্যাংয়ের একই এলাকার আকাশ হোসেন, সিয়াম হোসেন, ভাটপাড়া এলাকার তানজীদ, কালিয়াজুড়ি এলাকার ইয়াসিন আরাফাত ওরফে রাসেল, বাগমারা এলাকার আসিফ হোসেন রিফাতকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের দেখানো স্থান হতে দুটি সুইচ গিয়ার, চারটি বড় ছোরা ও একটি এন্টিকাটার উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আসামিদের দেওয়া তথ্য ও ঘটনাস্থলের প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে হত্যাকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

এর আগে গত বছরের ২৮ মে নওশাদ কবির মজুমদার ওরফে নাহিদ নামে কুমিল্লা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে মারধর করে এবং উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হাত ও পায়ের রগ কেটে গুরুতর আহত করেছে ‘আরজিএস’ নামের একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তুচ্ছ ঘটনায় ঐ গ্যাংয়ের জাহিদ খান নামের এক কিশোর তার সঙ্গীদের নিয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহের পাশে এ ঘটনা ঘটিয়ে ছিল। একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর অটোরিকশা ছিনতাইয়ের জন্য জেলার দাউদকান্দি উপজেলার শাহপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মো. আশ্রাফুল আমিন নামে ৮ম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ও নাক-মুখ স্কচটেপ পেঁচিয়ে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। ক্লু-লেস এ ঘটনার পর প্রযুক্তি ব্যবহার করে র‍্যাবের টিম ২৯ সেপ্টেম্বর কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। স্কুলছাত্র আশ্রাফুল পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের সহায়তার জন্য অটোরিকশা চালাত।

চলতি বছরের গত ৪ মে টিকটক গ্রুপের মধ্যে পূর্ব বিরোধের জেরে শুভ নামের কিশোরকে বুকে ও পেটে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। সে জেলার আদর্শ সদর উপজেলার আড়াইওড়া গ্রামের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের ছেলে। গোমতী নদীর পালপাড়া ব্রিজ এলাকায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এলাকার ১০-১২ জনের একটি কিশোর গ্রুপ টিকটক ভিডিও বানাত। কিশোর শুভ ঐ গ্রুপে ছিল। তুচ্ছ ঘটনায় তাদের মধ্যে বিরোধের জেরে এ খুনের ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ১৪ মার্চ বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাংয়ের সাত সদস্যকে নগরীর দৌলতপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে দুটি রামদা, দুটি সুইচ গিয়ার চাকু, দুটি ধারালো ছুরি, একটি খেলনা পিস্তল ও স্টিলের তৈরি লাঠিসহ দেশীয় তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তারা দেশীয় অস্ত্র ও খেলনা পিস্তল দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতির মাধ্যমে এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল বলে র‍্যাব জানিয়েছে।

গত ১২ আগস্ট নগরীর ধর্মসাগর গেটসংলগ্ন পিজা কালজুন রেস্টুরেন্টে তিন-চার জন কিশোর খাবার খেয়ে চলে যাওয়ার সময় বিল চাইলে না দিয়ে উলটো চাঁদা দাবি করে। অপারগতা জানালে গালমন্দের পর দোকানের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। তারা কাউন্টারে ঢুকে রেস্টুরেন্ট মালিক মো. শাহিদুজ্জামানকে আহত করে ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে যায়। এ সময় কাস্টমাররা এগিয়ে এলে রাব্বি ছুরি দেখিয়ে তাদের গালাগাল করে। পরে পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে এক জনকে আটক করে, বাকিরা পালিয়ে যায়। শাহিদুজ্জামান বলেন, হামলাকারীরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তাদের ভয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, শিশু-কিশোর অপরাধের বিষয়ে শুধু প্রশাসনকে দায়ী করলে হবে না, এ জন্য সন্তানের বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও সমাজের সচেতন ব্যক্তিবর্গকেও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।

Exit mobile version