Site icon Doinik Bangla News

খবর ও তথ্যপ্রযুক্তির নৈতিক দিক

সত্য তথ্য হলো সঠিক জ্ঞানের উৎস। গণমাধ্যম হলো তথ্যের বাহন। প্রযুক্তির মাধ্যমে তা সবার কাছে পৌঁছায়। সত্য জানতে বা সত্যে উপনীত হতে তথ্য অপরিহার্য বিষয়। তথ্যের সহজলভ্যতার

জন্য প্রযুক্তি খুবই প্রয়োজন। সব নবী ও রাসুলগণ (আ.) বিশ্বমানবতার উন্নয়নে ও সভ্যতার উৎকর্ষ সাধনে যে দাওয়াতি কাজ করেছিলেন, তাতেও তাঁরা সত্য তথ্য প্রচারে সময়োপযোগী মাধ্যম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন।

গণমাধ্যমের উন্নয়ন ঘটছে প্রতিনিয়ত, প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে অবিরত। পরিবর্তনের এই অবিরাম ধারায় যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলস্বরূপ প্রযুক্তি ও মিডিয়ার নানান নতুন সংস্করণ। কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এই নতুনের ধারা। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, ‘আর তিনি এমন কিছু সৃষ্টি করবেন, যা তোমরা (এখনো) জানো না।’ (সুরা: ১৬ নাহল, আয়াত: ৮)। ‘এভাবে আল্লাহ যা চান, তা সৃজন করেন।’ (সুরা: ৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৪৭)। ‘তিনি যা চান, তা সৃজন করেন।’ (সুরা: ৫ মায়িদাহ, আয়াত: ১৭)। ‘সৃষ্টি করেন আল্লাহ তিনি যা ইচ্ছা করেন।’ (সুরা: ২৪ নূর, আয়াত: ৪৫)। ‘আপনার রব যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং মনোনীত করেন।’ (সুরা: ২৮ কাছাছ, আয়াত: ২৮)। ‘সৃষ্টি করেন তিনি যা তিনি ইচ্ছা করেন।’ (সুরা: ৩০ রুম, আয়াত: ৫৪; সুরা: ৩৯ জুমার, আয়াত: ৪; সুরা ৪২, আয়াত: ৪৯)।

প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত জিনিসেই থাকে বিভিন্ন সুবিধা ও অসুবিধা। প্রয়োজন হলো এর যথাযথ প্রয়োগ বা সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য এবং অকল্যাণ থেকে পরিত্রাণের জন্য। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য দ্বিবিধ। যথা: ‘হক্কুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রতি কর্তব্য এবং ‘হক্কুল ইবাদ’ বা বান্দার প্রতি করণীয়। বান্দা হলো আল্লাহর সৃষ্টি সব বস্তু। মানুষের প্রতি মানুষের ‘হক্কুল ইবাদ’ বা বান্দার হক তিনটি। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের জন্য অন্য মানুষের ৩টি জিনিস সংরক্ষণ করতে হবে এবং তা এমন আমানত যা খেয়ানত বা ক্ষতি সাধন করা সম্পূর্ণ হারাম বা নিষিদ্ধ। তা হলো সব মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই মক্কা নগরী যেমন সম্মানিত, এই আরাফাতের প্রান্তর যেমন মর্যাদাবান, এই হজের দিবস যেমন ফজিলতপূর্ণ, এই কাবাঘর যেমন পবিত্র; প্রত্যেক মানুষের জান, মাল ও ইজ্জত অনুরূপ সম্মানীয় ও পবিত্র এবং তা অপরের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির)। তাই মিডিয়ার ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, আল্লাহর হক (শিরক ছাড়া) আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। কিন্তু বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, যতক্ষণ বান্দা তাকে ক্ষমা না করেন।

তথ্য আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম হলো দেখা ও শোনা। কোনো কিছু দেখা ও শোনার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো যা সরাসরি দেখা বা শোনা জায়েজ বা বৈধ, তা যেকোনো মাধ্যমে দেখা বা শোনা জায়েজ বা বৈধ। আর যা সরাসরি দেখা বা শোনা হারাম বা নিষিদ্ধ, তা যেকোনো মাধ্যমেই দেখা বা শোনা হারাম বা নিষিদ্ধ। সুতরাং যা জায়েজ বা বৈধ তা আপলোড বা ডাউনলোড করাও জায়েজ বা বৈধ এবং যা হারাম বা নিষিদ্ধ তা আপলোড বা ডাউনলোড করাও হারাম বা নিষিদ্ধ।

ইসলামে মিথ্যাকে সব পাপের জননী বলা হয়েছে। প্রতারক নবীজি (সা.)-এর উম্মত নয় বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গিবত শিকায়েত পরনিন্দাকে কোরআনে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান বলা হয়েছে। তুহমত বা মিথ্যা অপবাদ রটনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। (সুরা: ৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১২)।

উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিষয় বা বিবরণ অসম্পূর্ণ রাখা অথবা আংশিক পরিবর্তন করা এবং সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণ ও সত্য গোপন করা ইসলামে হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা জেনেশুনে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ো না, আর সত্যকে গোপন করো না।’ (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ৪২)। ‘কেন তোমরা জেনেশুনে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশাচ্ছ, আর সত্যকে গোপন করছ?’ (সুরা: ৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৭১)। এর জন্য পরকালে জবাবদিহি করতে হবে।

প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে যেসব তথ্য আসে; তার সত্যাসত্য যাচাই না করে, এর উৎস বা সূত্রের নির্ভরযোগ্যতা না জেনে, তা কখনো প্রচার বা পুনঃপ্রচার করা ঠিক হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যা শুনে তাই বলতে থাকা, মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (তিরমিজি)। যেসব তথ্য–উপাত্ত দেশ, জাতি, সমাজ ও জনগণের কল্যাণে উপকারে আসবে, সেসব প্রচার করা বিধেয়। আর যেসব বিষয় বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির কারণ হবে, তা প্রচার করা অনুচিত।

সঠিক তথ্যের প্রয়োজনে সহায়ক হিসেবে
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিবরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছবি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কখনো দেখা যায় কেউ কেউ কোনো কোনো ছবি বিকৃত করে বা পরিবর্তন করে অথবা ভিন্ন বিষয় বা বিবরণ সংযোজন করে প্রকাশ বা প্রচার করে থাকেন, যা একেবারেই অনৈতিক, মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী ও ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ।

পাপ বলতে সব পাপই সমান। কিন্তু কিছু পাপ সাময়িক অর্থাৎ এটি একবার সংঘটিত হওয়ার পর একবারই পাপ হয়। আবার এমন কিছু পাপ আছে যা একবার করলে তার গুনাহ চলতেই থাকে, যত দিন এর দ্বারা পাপ চলতে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজের সূচনা করল; সে তার পাপের অধিকারী হবে এবং ওই কাজের অনুগামীদের পাপের ভাগীদার হবে।’ (মুসলিম) সুতরাং গণমাধ্যমে কোনো অপরাধমূলক বা গর্হিত বিষয় প্রকাশের আগে এই বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Exit mobile version