Site icon Doinik Bangla News

গ্রামের চিকিৎসা: দায়িত্ব আমাদের সবার

গত ২১ ডিসেম্বর প্রথম আলোর ‘গ্রামে চিকিৎসার দায়িত্ব কারা নেবেন’ শিরোনামে স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। পেশাগতভাবে ভারতের দুটি রাজ্যের স্বাস্থ্যনীতি-বিষয়ক গবেষণায় সম্পৃক্ত থাকায় কলামটি আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসাব্যবস্থা শহরের মতো উন্নত নয়। এই সমস্যা ভারতেও আছে এবং বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই এই সংকটে আক্রান্ত। মানবসভ্যতার ১৫ হাজার বছরের ইতিহাসে এটা প্রমাণিত যে গ্রাম আছে বলেই শহরের জন্ম হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি শহরের বেঁচে থাকার খোরাক জোগায়। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ গ্রামে থাকে, অথচ বাকি ৩৫ শতাংশের জন্য আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ ও সেবা নিয়োজিত। এই বৈষম্যের দায় কার?

আলোচ্য কলামে লেখক এ ক্ষেত্রে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা যে বিস্তৃত, সেটা উল্লেখ করে সেই সেবার কাঙ্ক্ষিত মান না থাকার কারণ হিসেবে চিকিৎসকদের গ্রামে না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বৈষম্য না মেনে নেওয়া যে জাতি একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই জাতির বড় একটি অংশ কেন স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক বিষয়ে আজ বৈষম্যের শিকার, সেটা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করার জন্য ছয়টি বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন-প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, জনবল, চিকিৎসা সরঞ্জাম, তথ্য-উপাত্ত, সেবাদানের সঠিক নির্দেশিকা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। এর যেকোনো একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। যেমন ধরা যাক, কোনো একটি উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে যে পরিমাণ ওষুধ ও যন্ত্রপাতি দরকার, সেটা না থাকলে সেখানে কয়েক ডজন চিকিৎসক বসিয়ে রাখলে কোনো লাভ হবে না। অর্থ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের সবকিছু থাকলেও যদি ‘কীভাবে কাজ করতে হবে’ এবং ‘কে কতটুকু কাজ করবেন’-এসব নির্দিষ্ট না করা হয়, তাহলে নামকাওয়াস্তে স্বাস্থ্যকাঠামো টিকে থাকবে বটে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। এসব ধারণাপ্রসূত কথা নয়, ভূরি ভূরি গবেষণাপত্রে এসব তথ্য লেখা আছে। তারপরও কেবল চিকিৎসকের অনুপস্থিতিকে তুলে ধরলে যাঁরা সত্যিই গ্রামাঞ্চলে সীমিত সাধ্যে সেবা দিয়ে চলেছেন, তাঁদের কেবল অপমানই করা হয় না, বরং আরও যেসব অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে জোর দেওয়া প্রয়োজন ছিল, সেগুলোকে উপেক্ষাও করা হয়। যেহেতু ‘স্বাস্থ্যসেবা’ বাংলাদেশের সব নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, সেহেতু রাষ্ট্র এই ছয়টি নিয়ামকের সঠিক বরাদ্দ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে শহুরে ও গ্রাম্য স্বাস্থ্যকাঠামোর মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য কমবে বলে আশা করা যায়।

এবার চিকিৎসকদের গ্রামে থাকার প্রসঙ্গে আসা যাক। যদি বলি যে চিকিৎসকেরা গ্রামে থাকতে অত্যন্ত উৎসাহী, তাহলে সেটা অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট হবে। শুধু চিকিৎসক নন, দক্ষ পেশাজীবীদের অধিকাংশই গ্রামে থাকতে অনিচ্ছুক, যাঁরা ইচ্ছুক তাঁরা চাইলেও থাকতে পারেন না। এরপরও যাঁরা নানা প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে গ্রামে আছেন, তাঁদের সাধুবাদ জানাতে হয়। ভালো বাসস্থান, নিরাপত্তা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা শহুরে সাহেবেরা যেভাবে নিজেদের জন্য সাজিয়ে রেখেছেন, গ্রামে তার কিছুমাত্র নেই।

স্বাস্থ্য খাতের বৈষম্য দূর করতে গিয়ে কোনো কর্মচারীকে জোর করে গ্রামে রাখাও যুক্তিহীন, কারণ তাঁর সমকক্ষ বন্ধুরা শহরে সপরিবার সানন্দে বসবাস করছেন। এ রকম ঘটনা ভারতের রাজস্থানে ঘটেছিল, রাজ্য সরকার ডাক্তারদের গ্রামে থাকা বাধ্যতামূলক করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার ডাক্তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, গ্রামে থাকতে সমস্যা কী? একটি বড় অংশের উত্তরদাতারা বলেছিলেন, ‘আমি না হয় ভাঙাচোরা জায়গায় অফিস করলাম, কিন্তু আমার ছেলেমেয়ের কী হবে? ওদের জন্য স্কুল-কলেজ কই পাব?’ একপেশেভাবে কোনো নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে নয়, বরং এসব সংকটের বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজতে হবে।

মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার নীতি অনুসারে, যদি কোনো কর্মচারীর জীবনের উন্নতির সঙ্গে পেশাকে সমান্তরালে রাখা যায়, তাহলে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারেন। যেমন ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত সন্তানের পড়ালেখা নিয়ে ভাবনা কম। এই সময়টাতে একজন চিকিৎসককে চাকরি দিয়ে গ্রামে পদায়ন করলে তাঁর পক্ষে সেবা দেওয়া সহজতর হয়। এর সঙ্গে গ্রামে থাকাকালে যদি পেশাগত উন্নতির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ব্যাপারটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। যেমন অনেক দেশেই গ্রামে কাজ করার সময়টিকে স্নাতকোত্তরের জন্য প্রশিক্ষণকালীন সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চতর স্কেল বা পদে উন্নতির ব্যবস্থা থাকে। আমাদের দেশেও সেটি করা যেতে পারে।

উচ্চতর পড়াশোনার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন, সম্ভব হলে দূরশিক্ষণ কোর্স চালু করতে হবে। এমন সুবিধাদি কেবল চিকিৎসকদের জন্য নয়, বরং গ্রামপর্যায়ে কাজ করা সব পেশাজীবীর জন্যও নিশ্চিত করা প্রয়োজন, না হলে অন্যান্য সেবাদানকারীর সঙ্গে বৈষম্য সৃষ্টি করা হবে। স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসক যেমন প্রয়োজন, নার্স ও অন্যান্য জনবলের গুরুত্বও কিছুমাত্র কম নয়। কীভাবে সব পেশার দক্ষ ও তারুণ্যদীপ্ত জনবলকে গ্রামের মানুষের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি কাজ করলে এই তারুণ্যের সঙ্গে অভিজ্ঞ বয়োজ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের দক্ষতা যোগ করা যেতে পারে। সেটা হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। ধরা যাক একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নবজাতক বিশেষজ্ঞ নেই, কিন্তু যে চিকিৎসক আছেন, তিনি শহরে নবজাতক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে টেলি-কনফারেন্সের মাধ্যমে রোগের খুঁটিনাটি আলাপ করে আধুনিক চিকিৎসা দিতে পারেন। আইসিইউ এবং কিছু অত্যাধুনিক সুবিধা ছাড়া অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দেওয়া সম্ভব। এসব বিকল্প ব্যবস্থায় কীভাবে শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে।

প্রাসঙ্গিক একটি ছোট্ট গল্প দিয়ে শেষ করি। কয়েক দিন আগে আমার এক ছাত্র ফোনে জানতে চাইল, ‘বাংলাদেশে প্রতিদিন কত লোক যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে মারা যায়? আমাদের কি সম্পদের এতই অভাব যে এই মানুষগুলোর ভাগ্যে চিকিৎসা জোটে না?’ তার এই প্রশ্নের উত্তরটি বোধ হয় আমাদের সবারই জানা। আমাদের দেশে প্রচুর না হলেও অতীতের তুলনায় পর্যাপ্ত ডাক্তার ও অন্যান্য জনবল আছে, ওষুধ-যন্ত্রপাতিও আছে, কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক সেবা সঠিক জায়গায় সঠিক উপায়ে পাওয়ার আয়োজনটি নেই। চূড়ান্ত বৈষম্যে ভরা এই কাঠামোতে প্রতিদিন যত মৃত্যু হচ্ছে, আমরা কেউই তার দায় এড়াতে পারি না।

ডা. মাহবুব হোসেন: চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য গবেষক, আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এবং গবেষণা কর্মকর্তা, ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ, ভারত।

Exit mobile version