জাতীয় কবির মৃত্যু বার্ষিকী আজ

বাংলা নিউজ ডেস্কঃ বাংলা সাহিত্যের মঞ্চে আচমকাই উঠে এল তাঁর নাম। ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,/আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।/আমি মানব দানব দেবতার ভয়,/বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়…’। এই ছিল তাঁর আত্মপরিচয়। ‘অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন, ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন। তিনি প্রেম, সাম্য, মানবতা আর বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আজ ১২ ভাদ্র জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে চির অভিমানী কবির জীবনাবসান হয়। দীর্ঘদিন নির্বাক থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ঢাকায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।বাঙালি জাতি ভোলেনি জাতীয় কবিকে। মসজিদের পাশে শুয়ে আজানের মধুর ধ্বনি শোনার চিরকালীন সাধ ছিল তাঁর মনে। ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’—কবির এই ইচ্ছা স্মরণে রেখে তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই।

প্রয়াণ দিবসে আজ কবির সমাধি প্রাঙ্গণ ভরে উঠবে ফুলে ফুলে। জাতি আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করবে জাতীয় কবিকে।

কাজী নজরুল ইসলাম গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যর্থ অনুকরণ ও অনুসরণের কৃত্রিমতা থেকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে সফল। তিনিই রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ। নজরুল তাঁর কবিতা, গান ও উপন্যাসে পরাধীন ভারতে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে তুলনা করেছেন ধূমকেতুর সঙ্গে। বলেছেন, ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন’। আর কবি ধূমকেতুর মতো প্রলয়-নাচনে কাঁপন জাগিয়ে হতভম্ব করে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ রাজশক্তিকে।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মের পর দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। বাবার অকালমৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম, মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তবে নিজের দুঃখ নিয়ে নয়, তিনি জাতির দুঃখ-ক্লেশ-দৈন্য-লজ্জা ঘোচানোর জন্য ভাবতেন সব সময়।

স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে অসুস্থ কবিকে সপরিবার বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরে তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দিবসটি আজ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকা, ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও কুমিল্লায় কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ সারা দেশে পালিত হবে।

কুমিল্লায় বিভিন্ন কর্মসূচি:
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৬ তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ ২৭ আগষ্ট কুমিল্লায় দিনব্যাপি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন, কবি কাজী নজরুল ইন্সটিটিউট এবং নজরুল পরিষদ, কুমিল্লার উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানমালা আয়োজিত হবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে সকাল ৯ টায় চেতনায় স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পন, সকাল ১০ টায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইন্সটিটিউটে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বিকাল ৫ টায় আলোচনা সভা, পুরষ্কার বিতরণ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া কবির স্মৃতিধণ্য কুমিল্লা কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হবে।
নজরুল গবেষকদের ভাষ্য অনুসারে, কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৫ দফায় ১১ মাস কুমিল্লায় ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ছিল ব্রিটিশ নেতা প্রিন্স অব ওয়েলসের কলকাতা আগমনের দিন। এ উপলক্ষে ওই দিন ভারতীয় কংগ্রেসের ডাকা হরতাল ছিল। ওই হরতালের মধ্যে কবি নজরুল কুমিল্লায় গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে প্রতিবাদী গানে মিছিল করেন। ওই ‘অপরাধে’ কবিকে কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জনতার দাবির মুখে কোতোয়ালি থানায় কয়েক ঘণ্টা আটক রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আবার ১৯২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’কবিতার জন্য কবিকে শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। পরদিন তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়।
অন্যদিকে গোমতী বিধৌত কুমিল্লার নার্গিস ও প্রমীলা ছিলেন কবির বহু রচনার অনুপ্রেরণা। এছাড়া কবির অনেক স্মরণীয় মূহুর্ত কেটেছে কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এসব জায়গায় সংগীতচর্চা ও কাব্যরচনার পাশাপাশি তিনি সংস্কৃতিপাগলদের সঙ্গে মিশে গলা ছেড়ে গান গেয়েছেন। আমোদে-আড্ডায় মাতিয়ে রেখেছেন চারপাশ।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরীর মতে, ‘জাতীয় কবির প্রেম ও বিয়ে থেকে তার সুরকার, গায়ক ও অভিনয়শিল্পী হয়ে উঠাসহ অনেক কিছুরই শুরু কুমিল্লা থেকে।’

Leave a Reply