Site icon Doinik Bangla News

দেশপ্রেম ইমানদারের বৈশিষ্ট্য

মানুষ মহান আল্লাহ তাআলার মহা সৃষ্টি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃজন করে ভালো-মন্দ উপলব্ধি ও কর্তব্য জ্ঞান দিয়ে স্বাধীনতা দান করেছেন। মানুষ নিজ নিজ বিবেকের অনুসরণ করবে এবং স্বীয় কৃতকর্মের জন্য আপন স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করবে। আসমানি কিতাব ও নবী-রাসুলগণ মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে সহযোগিতা করেছেন।

পরাধীন দেশের মজলুম মানুষের সাহায্যকারী ও ত্রাণকর্তা হিসেবে আল্লাহ যুগে যুগে তাদের মুক্তির জন্য কিছু মানুষকে প্রেরণ করেন, যা কোরআনে করিমে বিবৃত হয়েছে, ‘অসহায় দুর্বল নারী, পুরুষ ও শিশুরা বলে, হে আমাদের রব! আমাদিগকে এই জালিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে মুক্তি দিন। আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাঠান।’ (সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ৭৫)। স্বাধীনতা ও বিজয়ের জন্য প্রচেষ্টা, সাধনা ও দোয়া করতে হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের পরিবর্তনে সচেষ্ট হয় না।’ (সুরা: ১৩ রাআদ, আয়াত: ১১)।

বিজয়ের মালিক আল্লাহ। কোরআনুল করিমে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিব (সা.)-কে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করব। এবং আল্লাহ আপনাকে প্রবল সাহায্য করবেন।’ (সুরা: ৪৮ ফাৎহ, আয়াত: ১ ও ৩)। আল্লাহর সাহায্যেই বিজয় আসে। কোরআন মজিদে বলা হয়েছে, ‘যখন আসে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, তখন মানুষকে দেখবেন দলে দলে আল্লাহর দ্বীন ইসলামে দাখিল হচ্ছে। তখন আপনি তাসবিহ পাঠ (আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা) করুন, আপনার রবের হামদ (গুণগান) করুন এবং তাঁর নিকট ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করুন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বাধিক তওবা গ্রহণকারী।’ (সুরা: ১১০ নাসর, আয়াত: ১-৫)।

বিজয়সংক্রান্ত বিষয়ে মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে দুটি সুরা রয়েছে। তার একটি হলো সুরা আল ফাৎহ, যার ক্রমিক হলো ৪৮, এটি অবতীর্ণের ক্রম হলো ১১১। এই সুরাটি ষষ্ঠ হিজরিতে ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধি-পরবর্তীকালে পবিত্র মক্কার নিকটবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে অবতীর্ণ হয়। মক্কায় অবতীর্ণ হলেও হিজরতের পরে অবতীর্ণ বিধায় এই সুরাটি মাদানি সুরা। বিজয় কীভাবে অর্জিত হবে, বিজয়ের জন্য করণীয় কী, স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জনের কর্মপন্থা কেমন হবে; এসব বিষয় এই সুরায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বিজয়সংক্রান্ত দ্বিতীয় সুরাটি হলো সুরা আন নাসর, এর ক্রমিক হলো ১১০, এটি অবতীর্ণের ক্রম হলো ১১৪। এই সুরাটি দশম হিজরিতে ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণের পর পবিত্র মক্কা নগরীর আরাফাতের মাঠে অবতীর্ণ হয়। মক্কায় অবতীর্ণ হলেও হিজরতের পরে অবতীর্ণ বিধায় এই সুরাটি মাদানি সুরা। এই সুরায় বিজয়-পরবর্তী করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বিজয় আসে আল্লাহর সাহায্যে। বিজয় এলে বিনয়ের সঙ্গে আল্লাহর হামদ, তাসবিহ ও তাওবা ইস্তিগফার করতে হবে।

মুসলিম রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব হলো তার স্বদেশ ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। প্রিয় নবীজি (সা.) যখন স্বীয় মাতৃভূমি মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে ইয়াসরিব তথা মদিনায় যাত্রা করেন, তখন তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং বলেছিলেন, ‘হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ৪০৪)।

হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) মদিনা শরিফকেও খুব ভালোবাসতেন। কোনো সফর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে মদিনার সীমান্ত ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে নবীজি (সা.)-এর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত এবং তিনি বলতেন, এই ওহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

দেশপ্রেম, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা হচ্ছে ইমানদারের বৈশিষ্ট্য। বিজয় দিবস আমাদের গৌরব, অহংকার। সবাই মিলে আল্লাহর দরবারে বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে শুকরিয়া প্রকাশ করা আমাদের কর্তব্য। আর মহান আল্লাহর কাছে নিবেদন করা, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের স্বাধীন ভূখণ্ড দান করেছেন, তাই আপনার শুকরিয়া আদায় করি, আপনার প্রশংসা করি, আপনি পবিত্র! আপনি আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের হেফাজত করুন। সম্মানের সঙ্গে যেন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারি, সে তৌফিক দান করুন। স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় লাভে যাঁদের ত্যাগ ও অবদান রয়েছে, তাঁদের ইহকাল ও পরকালে উত্তম বিনিময় দান করুন।

বিজয় দিবসের করণীয় সম্পর্কে আল্লাহর নবীর (সা.) আদর্শ ও করণীয় আমল সম্পর্কে হজরত ইবনুল কাইয়িম জাওজি (রহ.) (মৃত্যু: ৫৯৭ হিজরি) তাঁর কালজয়ী অনবদ্য গ্রন্থ জাদুল মাআদ-এ উল্লেখ করেন, আল্লাহর নবী (সা.) একটি উষ্ট্রীর ওপর আরোহণাবস্থায় ছিলেন, তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী। অর্থাৎ, আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সঙ্গে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন, সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এই নামাজকে বলা হয় ‘সলাতুল ফাৎহ’ বা বিজয়ের নামাজ। এরপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি (সা.) বলেন, হে মক্কাবাসী সম্প্রদায়! বিগত ২১ বছর ধরে তোমরা আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবাদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছ, আজ আমি তার কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করব না। আল্লাহর নবী (সা.) আরও বললেন, আজ আমি তোমাদের সবার জন্য হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। (সুনানে বায়হাকি, খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ১১৮)। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব, অনন্যতা এখানেই। শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো বিশ্বকে এই বার্তা দিলেন, আমরা শান্তির পক্ষে; অন্যায়, অত্যাচার, প্রতিহিংসা ও জুলুমের বিপক্ষে। আসুন, বিশ্বশান্তি ও মানবতার বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করি।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Exit mobile version