Site icon Doinik Bangla News

নতুন বছর নতুন জীবন

সময় আল্লাহর দান। সময়ের সমষ্টিই জীবন। প্রতি পলে মানবের বয়স বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে আয়ু কমে সমানতালে। তিল, পল, মুহূর্ত, দণ্ড, প্রহর, আহ্ন, দিবস, রজনী, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী ইত্যাদি মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী সময়ের প্রাকৃতিক বিভিন্ন বিভাজন। আল্লাহপাক কোরআন করিমে ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি।’ (সুরা: ৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬)। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন: ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং উহাদের মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বত্সর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’ (সুরা: ১০ ইউনুস, আয়াত: ৫)। কোরআন হাকিমে মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘আর সূর্য ভ্রমণ করে উহার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। এবং চন্দ্রের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মঞ্জিল; অবশেষে উহা শুষ্ক বক্র পুরোনো খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে।’ (সুরা: ৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ৩৮-৩৯)।

নতুন বছর আসা মানে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়া। নতুন বছর আসা মানে জীবনের নির্ধারিত আয়ু থেকে একটি বছর চলে যাওয়া। বিগত সময়ের ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন উদ্যমে নতুনের কেতন ওড়ানোর আনন্দ উপভোগ করা। অকল্যাণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে অবারিত কল্যাণের

পথে ধাবিত হওয়ার শুভযাত্রা শুরু করা। নতুন মাস দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। নতুন মাসে সময়ের মালিকের কাছে এই আবেদন: ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ইমান, ওয়াছ ছালামাতি য়াল ইসলাম; রব্বি ওয়া রব্বুকাল্লাহ; হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলাম–সহযোগে আনয়ন করুন; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৩৪৫১, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৪০০, রিয়াদুস সালিহীন, হাদিস: ১২৩৬)।

সময়ের সঙ্গে কোনো অমঙ্গল বা অকল্যাণের সংযোগ নেই। কল্যাণ-অকল্যাণ ও মঙ্গল-অমঙ্গল মানুষের কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হাদিস শরিফে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা সময়কে দোষারোপ কোরো না, কালকে গালমন্দ কোরো না; কারণ, আমিই মহাকাল, আমিই সময়ের নিয়ন্তা। (হাদিসে কুদসি)।

ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)-এর দাদা তাঁর পিতা ছাবিত (রহ.)–কে পারস্যের নওরোজের দিনে হজরত আলী (রা.)-এর নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন এবং হজরত আলী (রা.)–কে কিছু হাদিয়া পেশ করেছিলেন। হাদিয়াটি ছিল নওরোজ উপলক্ষে। তখন হজরত আলী (রা.) বললেন, ‘নওরোজুনা কুল্লা ইয়াওম।’ অর্থাৎ মুমিনের নওরোজ প্রতিদিনই। মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব-নিকাশ করবে এবং নতুন উদ্যমে আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। (আখবারু আবি হানিফা রহ.)।

পুরোনো বছরের তথা অতীতের পাপরাশির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, সেই সঙ্গে নতুন বছরে পাপকাজ না করার এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের স্বার্থে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করা, আল্লাহর আনুগত্যের তৌফিক কামনা করা, দেশ ও সমগ্র মুসলিম জাতির সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি কামনায় আল্লাহর কাছে বিশেষ প্রার্থনা করা।

যেহেতু নববর্ষ হলো সময়ের একটি অংশ থেকে অন্য অংশে পদার্পণ, তাই এটিও হলো নিজেকে পরিবর্তন ও উন্নয়নের একটি সুযোগ। সুতরাং এই সময়ে আমাদের যা করা উচিত তা হলো জীবনকে নবায়ন করা। জীবনের জন্য আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করা। নেক হায়াতের জন্য দোয়া করা। অতীতের গুনাহ থেকে তাওবা করে কৃত ভুলের জন্য ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করা। কারও জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া এবং সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া। ভবিষ্যতে নেক আমলের সংকল্প করা। বিগত সময়ে কেউ বিরূপ আচরণ করে থাকলে মন থেকে তা ক্ষমা করে দেওয়া। কারও কাছে বৈধ দেনা-পাওনা বা লেনদেন থাকলে তা আদায়ে বিধিসম্মত সামাজিক পন্থা অবলম্বন করা। সব মানুষ যেন সুখে-শান্তিতে থেকে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে, সেই প্রার্থনা করা।

নববর্ষ হলো সময়ের একটি অংশ পার হয়ে অন্য অংশে গমন করা। নববর্ষ জীবনের স্মৃতি ও আমলনামায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। তাই এই সময়ে এমন কোনো কাজ করা কাম্য নয়, যা যেকোনো সময়ই করা উচিত নয়। নববর্ষ মানে এই নয় যে আজ এই সময়ে আমলনামা লেখা থেকে ফেরেশতারা বিরত থাকবেন। আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআনে বলেন: ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য করিতকর্মা প্রহরী রয়েছে তার নিকটেই।’ সুরা: ৫০ কাফ, আয়াত: ১৮)। অর্থাৎ মানুষ যখন যেখানে যে অবস্থায় যা করে, যা বলে, যা ভাবে—সবই ফেরেশতাগণ লিপিবদ্ধ করে তার আমলনামায় সংরক্ষণ করেন। সুতরাং নববর্ষের মতো সময়ের একটি এহেন গুরুত্বপূর্ণ পর্বে এমন কোনো কাজ করা সমীচীন হবে না, যা আমাদের আমলনামা বা জীবনপঞ্জিকে কলঙ্কিত করবে। হজরত আলী (রা.) বলেন: তুমি রাতের আঁধারে এমন কোনো কাজ কোরো না, যার কারণে তোমাকে দিনের আলোয় মুখ লুকাতে হবে।

নেক আমল বা সত্কর্মের মাধ্যমে বছর শুরু করা বাঞ্ছনীয়, যাতে নতুন বছরের নতুন প্রভাত নবজীবনের আহ্বান নিয়ে আসে, নতুন উষা নতুন প্রাণের সঞ্চার করে, নতুন প্রভাত নবদীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়, নতুন সকাল নবজাগরণী হয়ে আসে, নতুন প্রহর শুদ্ধ চেতনা জাগ্রত করে, নতুন দিন সমৃদ্ধি ও উন্নতির সোপান হয়ে ধরা দেয়। নতুন সূর্য যেন জীবনের জয়গান গায়।
যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) অসন্তুষ্ট হন; যাতে মানুষের অকল্যাণ হয়, তা–ই হচ্ছে বদ আমল বা অসত্কর্ম। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কোনো মানুষের জীবনহানি করা বা শারীরিক বা দৈহিক ক্ষতি করা, কারও সম্পদহানি করা বা আর্থিক ক্ষতি করা, কারও সম্মানহানি করা বা মান-ইজ্জতের ক্ষতি করা। এসব বদ আমল থেকে যেন আমরা বিরত থাকি।
অন্যদিকে যাতে আল্লাহ ও রাসুল (সা.) সন্তুষ্ট হন; যাতে মানুষের মঙ্গল হয়, সেগুলো হচ্ছে নেক আমল। আপ্যায়ন–আতিথেয়তা, দান-খয়রাত, সদুপদেশ, মঙ্গল প্রার্থনা এবং নামাজ, রোজা, কোরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ, তাসবিহ–তাহলিল ও তাকবির, জিকির-আসকার, তাওবা-ইস্তিগফার ইত্যাদি হচ্ছে নেক আমল।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Exit mobile version