Site icon Doinik Bangla News

প্রকৃতি ও আধুনিকতার মিশেল

সুকুমার রায়ের ‘খিচুড়ি’ ছড়া থেকে হাঁসজারু, হাতিমি কিংবা বকচ্ছপের কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু টমআলু—সেটা কী জিনিস! এমনই এক অদ্ভুত গাছের দেখা পেলাম ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) ক্যাম্পাসে। গাছের ওপরের অংশে টমেটো আর নিচে আলু! যদিও এখনো ফল ধরেনি। এই সংকর প্রজাতির সবজি গাছের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিষয়ের শিক্ষার্থী সুরাইয়া শারমিন। সুরাইয়া বলেন, ‘আমাদের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা গবেষণার মাধ্যমে নতুন জাতের সবজি তৈরির চেষ্টা করছেন, যার ফলই হলো টমআলু। আমরা ক্লাসরুমে যতটা পড়ি, তার চেয়ে বেশি মাঠেঘাটে আর হাতে-কলমে শেখান শিক্ষকেরা।’ উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের কাছে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাসের পেছনে দেখা গেল বিরাট পুকুর, বিভিন্ন গবেষণাগার আর বিশাল খেলার মাঠ। বোঝা গেল, এখানে ক্লাসরুমের বাইরে শেখার মঞ্চটা তৈরিই আছে।

ক্লাসরুমের পরিবেশও মজার। এই তথ্য দিলেন বিবিএর ছাত্রী আনজুম আরা। বললেন, ‘আন্তর্জাতিক ব্যবসা ক্লাসে কয়েক দিন ধরে রীতিমতো অভিনয় করে স্যার আমাদের শেখাচ্ছেন কীভাবে বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, কথা বলতে হয়। এমনকি চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কেও আমাদের পড়তে হচ্ছে।’ আনজুম আরার কথার সঙ্গে মাথা ওপর-নিচ করে সায় জানালেন বুরশানা আকতার, সাবরিনা হাসান আর আবদুল্লাহ মাছুম। বুরশানা বলেন, ‘আগের ক্লাসে যা যা পড়ানো হয়েছে, সেগুলোর রিভিউ করে প্রতিদিন ক্লাস শুরু হয়। অতএব অমনোযোগী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ শফিকুল ইসলাম আর সারজীনা শান্তা যোগ করলেন, ‘প্রথম দিকে একটু কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু এভাবে পড়াশোনা করলে লাভ তো আসলে আমাদেরই। ক্লাসরুম থেকেই আমরা ইংরেজি ভাষার দক্ষতা, পাবলিক স্পিকিংসহ বিভিন্ন মানসিক, প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতা সম্পর্কে শিখে ফেলি।’
পুকুর, মাঠ, সবই আছে এখানে। ছুটির দিনেও চলে আসেন শিক্ষার্থীরা
পুকুর, মাঠ, সবই আছে এখানে। ছুটির দিনেও চলে আসেন শিক্ষার্থীরা
লাল রঙের আইইউবিএটি বিশ্ববিদ্যালয় ভবন। একেকটা করিডরে দেখা গেল বিশাল বিশাল টাচস্ক্রিনের মনিটর। মনিটর ছুঁয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীরা খুঁজে নিতে পারেন তাঁদের প্রয়োজনীয় তথ্য। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে প্রথম যাত্রা শুরু করে আইইউবিএটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা আলিমুল্লাহ মিয়ানের নেতৃত্ত্বে সেই থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আইইউবিএটির ব্লুজ ক্লাবের সদস্য আবদুল্লাহ মাছুম জানালেন, ‘আমাদের সব শিক্ষার্থীই কোনো না কোনো ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনও বেশ কার্যকর। ফলে সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ ভালো একটা নেটওয়ার্ক আছে।’ সারা বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাবের উৎসব, প্রদর্শনী ও জাতীয় দিবসসহ বিভন্ন উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কারণে ক্যাম্পাসের মুক্ত মিলনায়তনটা মুখরিত থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানা গেল, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজনও হয় এই মিলনায়তনে।
আইইউবিএটিতে পড়ালেখা ও ক্যারিয়ারকে সমান গুরুত্ব দিয়েই পাঠ্যক্রম সাজানো হয়েছে, বললেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী অনিতা আক্তার। জিমন্যাস্টিকসে বেশ কয়েকবার জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক জিতেছেন এই তরুণী। অনিতা বলেন, ‘পড়ালেখার পাশাপাশি সৃজনশীলতার বিকাশকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমি একই সঙ্গে পড়েছি আবার খেলেছি। শিক্ষক ও বন্ধুরা আমাকে দারুণভাবে সহায়তা করেছেন।’
চলছে কৃষি বিভাগের ব্যবহারিক ক্লাস
চলছে কৃষি বিভাগের ব্যবহারিক ক্লাস
আইইউবিএটিতে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখা করছেন। মোট ছয়টি অনুষদের জন্য আছেন প্রায় ৩০০ শিক্ষক। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে সরাসরি হাতে-কলমে পড়াশোনা চলে দীর্ঘ টিনশেড ভবনটিতে। চারপাশে সুনসান নীরবতা। যন্ত্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ের ল্যাবগুলো বেশ বড়।
মজার একটা তথ্য দিলেন বিবিএর শিক্ষার্থী রবিন ও সাজ্জাদ। ‘আমাদের ক্যাম্পাস খুব সুন্দর। তাই প্রায়ই নাটক, সিনেমা কিংবা বিজ্ঞাপনের শুটিং হয় এখানে।’ সবুজ ক্যাম্পাসটির এখানে-ওখানে জমে রঙিন আড্ডা। ক্যামেরার ক্লিক আর গিটারের টুংটাং শব্দ আড্ডায় যোগ করে আরও আনন্দ। একপাশে দেখা গেল ক্রিকেটের আসর। ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে নেমে গেছেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। ক্রিকেটারদের একজন ইশফাক বললেন, ‘এখনো ক্লাস শুরু হয়নি বলে ক্যাম্পাসে আসা তো বন্ধ করা যায় না। তাই ক্রিকেট খেলতে চলে এসেছি।’
ক্যাম্পাস ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো দুই বিদেশি বন্ধু মেহমুদ জামা আর আবদিকাফির সঙ্গে। সোমালিয়ার দুই তরুণ আইইউবিএটিতে পড়ছেন। ক্যাম্পাস আর পড়াশোনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বললেন, ‘কুরাক্স বাদান’। পাশ থেকে বাঙালি বন্ধুরা বুঝিয়ে বললেন, ‘সোমালি ভাষায় “কুরাক্স বাদান” অর্থ হলো সুন্দর।’ এরপরে মেহমুদ আধো বাংলায় বললেন, ‘সুন্দর বাংলাদেশ। আইইউবিএটিতে অনেক বন্ধু আছে আমার।’ আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা আইইউবিএটিতে পড়তে আসেন। দেশি-বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের কলরবে প্রতিদিন মুখর হয় এই ক্যাম্পাস।
পেশাজীবনের প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের পোশাক, যোগাযোগের দক্ষতা ও চালচলনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়
পেশাজীবনের প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের পোশাক, যোগাযোগের দক্ষতা ও চালচলনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়

প্রতিটি গ্রামে যেন আমাদের অন্তত একজন স্নাতক থাকেন
আবদুর রব
উপাচার্য, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি
আবদুর রব
আবদুর রব
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তি হলো দক্ষ শিক্ষক, উন্নত পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষার মান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পিএইচডি করা দেশি–বিদেশি শিক্ষকেরা আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে নান্দনিকতা যোগ করেছেন। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আলিমুল্লাহ মিয়ানের লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে যেন আমাদের অন্তত একজন স্নাতক থাকেন। দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় এখন আমাদের গ্র্যাজুয়েট আছে। আমরা প্রথম থেকেই সবার জন্য উচ্চশিক্ষা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। যাদের অর্থের সংগতি নেই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জন্য বিশেষ সহায়তার ব্যবস্থা আছে। আমরা ক্লাসরুমের পড়াশোনাকে এমনভাবে সাজিয়েছি যেন একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে নিজ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে। গবেষণাকে আমরা অগ্রাধিকার দিই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে যেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ পায়, সেদিকেও খুব জোর দেওয়া হয়। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা দেশের কৃষি, প্রযুক্তি, শিল্প আর অর্থনীতিতে আধুনিক মানবসম্পদ বিকাশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

Exit mobile version