Site icon Doinik Bangla News

‘ব্যাংকে ভীতি সৃষ্টি করেছিলেন বাচ্চু’

বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক শিপার আহমেদ বলেছেন, বেসিক ব্যাংকে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছিলেন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। ব্যাংকে তাঁর ছিল একচ্ছত্র দাপট ও খামখেয়ালিপনা।
শিপার আহমেদ নিজেও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির একজন অভিযুক্ত। ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় ব্যাংকের গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন তিনি। তাঁর সময়ে সুরমা স্টিল অ্যান্ড স্টিল ট্রেডিং নামের একটি কোম্পানিকে ঋণের নামে ৫৫ কোটি টাকা দেয় গুলশান শাখা। এ ঘটনায় দুদকের মামলায় ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন শিপার আহমেদ। আর জামিন পান গত ৩ আগস্ট। এর আগে দুদকের তদন্ত দলের কাছে ২০১৫ সালের ১৫ জুন শিপার আহমেদ যে লিখিত বক্তব্য দেন, তাতে উঠে আসে আবদুল হাই বাচ্চুসহ ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতির বিচিত্র কাহিনি। জামিন পেতে এই বক্তব্য আদালতের কাছে তুলে ধরেন শিপার আহমেদের আইনজীবী। আদালতও তা আমলে নেন।
এর আগেও আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল চার বছর আগেই। মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) বিশেষ নিরীক্ষায়ও এই পর্ষদের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। এর আগে বেসিক ব্যাংকের এক পরিচালক অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে ব্যাংক ধ্বংসে আবদুল হাই বাচ্চুর কীর্তিকলাপ তুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় আবদুল হাই বাচ্চু বা পর্ষদের কারও নাম ছিল না। আদালতের নির্দেশে দুদক শেষ পর্যন্ত পর্ষদের সবাইকে নোটিশ দেয় এবং গত সোমবার সংস্থাটিতে এসে জবানবন্দি দিয়ে যান আবদুল হাই বাচ্চু। শুনানি শেষে তিনি বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর দোষ চাপান। তবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষেরই একজন সদস্য শিপার আহমেদ সরাসরি আবদুল হাই বাচ্চুকেই দায়ী করেন।
যোগাযোগ করলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আত্মরক্ষার জন্য আবদুল হাই বাচ্চুর মতো অনেকেই নিজেদের নির্দোষ দাবি করতে পারেন। সেটা সমস্যা না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন, সিএজির বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ শিপার আহমেদের মতো অনেকের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের পরও যদি আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, আমি খুবই অবাক হব।’
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক আগেই আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিতে বলেছিল। সরকার যথাসময়ে তা ভাঙেনি। আর আবদুল হাই বাচ্চু যে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুলছেন, তা আমলে নেওয়ার মতো না। কারণ, এত দিন ধরে চলা এত বড় কেলেঙ্কারি পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ অনুমোদন ছাড়া অসম্ভব।’
শিপার আহমদকে দেওয়া জামিনের রায় বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে তাঁকে কিছু ঋণ প্রস্তাবের সুপারিশ করতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মঞ্জুরিপত্র ইস্যুর সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত কাগজপত্রও তৈরি করতে হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান ও এমডির সঙ্গে শাখার কিছু প্রভাবশালী গ্রাহকের গভীর সম্পর্ক ছিল। তাঁরা অনুচিত প্রভাব খাটাতেন। ফলে পেশাগতভাবে ঋণ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বেনামি, ভুয়া জামানত ও নামসর্বস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রস্তাব বিবেচনা না করায় তাঁকে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং অনেকের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। জীবন-জীবিকা ও মানসম্মানের ভয়ে অনেক কিছু মেনে চলতে হয়েছে। ছিল চাকরিচ্যুতির ভয়। ব্যাংকের শৃঙ্খলা পরিস্থিতি (চেইন অব কমান্ড) মেনে চলতে হয়েছে।
শিপার আহমেদ আরও বলেন, গোটা ব্যাংকে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। সব সময় তিনি মৌখিক নির্দেশনা দিতেন। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) হওয়ার আগে ঋণ বিতরণ সম্পর্কিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনটি ছিল শুধু নামে। বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ ছিল না। মৌখিক নির্দেশনাগুলো সব সময়ই কাজী ফখরুল ইসলামের নজরে আনা হতো উল্লেখ করে বলা হয়, ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কমিটি ছিল নিষ্ক্রিয় ও অকার্যকর। গ্রাহকেরা তৎকালীন চেয়ারম্যান ও এমডির আশীর্বাদপুষ্ট থাকায় অনুচিত প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করতেন। বিশেষ করে সহায়ক জামানতের মূল্যায়নের ব্যাপারে তাঁরা সাংঘাতিক প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করতেন।
আদালতকে আরও জানানো হয়, ‘একটি অতি ক্ষমতাধর ও স্বার্থান্বেষী মহলের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের কারণে গর্বিত ব্যাংকটি আজ ধ্বংসের পথে। শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর একচ্ছত্র দাপট, খামখেয়ালিপনা এবং তা মোকাবিলায় কাজী ফখরুল ইসলামের ব্যর্থতা ও নতজানু নীতি ব্যাংকটাকে ধ্বংসের প্রান্তে দাঁড় করিয়েছে।’
পরিচালনা পর্ষদের দায়ের কথা উল্লেখ করে শিপার আহমেদ বলেন, ‘শাখা পর্যায়ে আমাদের যেমন ব্যর্থতা রয়েছে, তেমনই আমাদের যাঁরা পরিচালনা করেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই ব্যর্থতা আছে। ঋণ মঞ্জুরি, বিতরণ, নিরীক্ষা কার্যক্রমসহ সব পর্যায়ে নিয়মনীতি মেনে চললে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হতো না এবং আমাদেরও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো না।’
এর আগে ২০১৩ সালের ১১ জুলাই শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালক এ কে এম রেজাউর রহমান। চিঠি দেওয়ার পর তিনি আর বেসিক ব্যাংকে যেতে পারেননি। ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, আগের সভার কার্যবিবরণী উপস্থাপন ছাড়াই সভা শুরু করতেন আবদুল হাই বাচ্চু। কোনো ঋণ প্রস্তাব নিয়ে কথা বলতে চাইলে চেয়ারম্যান ‘আলোচনার প্রয়োজন নেই’ বলে পাতা উল্টিয়ে পরবর্তী বিষয়ে চলে যেতেন।

Exit mobile version