Site icon Doinik Bangla News

ভার্চুয়াল শিক্ষা;আমাদের সন্তানদের কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে? (পর্ব-১)

মোঃ কাশেদুল হক কাজলঃ ভার্চুয়াল শিক্ষা  আমাদের সন্তানদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে প্রথমে আলোকপাত করা যাক, শিক্ষা বলতে আমরা কি বুঝি? মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই সৃষ্টির সেরা জীবটি আসলে কি শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত? শিক্ষার উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত? আর আমরা আমাদের সন্তানদের কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য নিজেরা প্রত্যেকের অবস্থান থেকে কি না ঘাম ঝড়া, হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম কিংবা প্রতিযোগিতা করছি? আমরা অভিভাবকরাই কি সঠিক পথে আছি? আমাদের অভিভাবকদের ও যদি নীতি নৈতিকতার বালাই না থাকে, তবে আমাদের সন্তানরা এগুলো শিখবে কোথা থেকে? নিজের সন্তানদের ভাল নামি দামি স্কুলে ভর্তি করার জন্য আমরা উৎকোচ কিংবা টাকা দিতে একবারও চিন্তা করি না, ঘোষ দিয়ে আমার সন্তানের শিক্ষার জীবন শুরু করলাম, একদিন এ সন্তান বড় হয়ে আমাকে কি দিবে কিংবা জাতিকে কি দিবে? এ নিয়ে আমরা অভিভাবকগণ একবার ও চিন্তা করি না। কেন জানি সবাই এটাকে রেওয়াজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের অপরাধকে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছি মনে হয়। যে শিক্ষায় শিক্ষিত হলে বেশি উপার্জন করা যায়, বলতে গেলে আমরা সবাই আমাদের সন্তানদের সে শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রতিযোগিতাই করছি। যে শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এই সেরা জীবটি সত্যিকার মানুষ হতে পারে। নিজেকে একজন সত্যিকার মানুষ ভাবতে পারে। সমস্ত অন্যায় অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে কিংবা অন্যায় অপরাধ বন্ধ করতে পারে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি তাহার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারে। ইহকাল ও পরকাল সুন্দর ও সফল হতে পারে, আমাদের সন্তানদের সে শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রতিযোগিতা আমরা করছি না। আমরা সবাই নিজেদের সন্তানকে ভালো উপার্জনের কারখানা বানাতে চাই। এই গেল আমাদের অভিভাবকদের চিন্তা ভাবনার দুরাবস্থার কথা।এবার আসা যাক, একজন মানুষ পরিপূর্ণ শিক্ষিত হতে হলে, কি কি শিক্ষা অর্জন করতে হয়? কোথায় করতে হয়? পরিপূর্ণ শিক্ষাটাকে আমাদের শিক্ষাবিদেরা চার ভাগে ভাগ করেছেন। তাতে অনেকের মতান্তর কিংবা ভিন্ন অভিমত থাকতে পারে। পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা এবং প্রাতিষ্ঠানিক তথা উপার্জনের শিক্ষা। যদিও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক শিক্ষাসহ সকল শিক্ষাই নিহিত আছে, তবে আমাদের বিদ্ধানগন ধর্মীয় শিক্ষাটাকে পিছনে রাখার জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নামকরণে এগুলোকে আলাদা আলাদা রূপ দিয়েছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে আবার নতুন দিগন্তর আমাদের ভার্স্যুয়াল শিক্ষা।

করোনা মহামারির কারণে করোনা বিস্তার রোধে সরকার শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে গিয়ে কিংবা বাধ্য হয়ে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে ভার্স্যুয়াল শিক্ষার অনুশীলন করাতে শুরু করে। আমাদের সন্তানরাও একধাপ এগিয়ে গিয়ে প্রাথমিকের ছেলে মেয়েরা স্মার্ট ফোনের জন্য পরিবারের কর্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে দিল। অভিভাবকগণ নিরুপায় হয়ে তাদের সন্তানদের হাতে একটি স্মার্ট মোবাইল নামীয় একটি আজব যন্ত্র ধরিয়ে দিতে বাধ্য হলো। আমাদের শিক্ষার্থীরাও আজব যন্ত্রটি হাতে পেয়ে পৃথিবীটাকে তাদের হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে বলে ভাবতে শুরু করে। আমাদের অভিভাবকগনের মধ্যে অনেকে সন্তানদের মোবাইল চালানোর পারদর্শিতা দেখে ভিতরে ভিতরে গর্ববোধ করতে শুরু করল। প্রতিবেশী ভাবির সাথে আলাপচারিতায় নিজের সন্তানের মোবাইল চালানোর পারদর্শিতার গল্প করতে কখনো ভুলে না। একবার বলা হলেও পরের দিন আবারও সে বলে নিজের সন্তানের মোবাইল চালানোর পারদর্শিতার গল্প । একবারও ভাবার সুযোগ হয় না, তাতে আমাদের সন্তানরা আজব যন্ত্রটিতে কতটুকু সময় শিক্ষার জন্য ব্যয় করছে আর কতটুকু সময় ফ্রি ফায়ার, পাবজি কিংবা অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। এর মাঝে একটা কথা মনে পড়ে গেল। আগের দিনে কোন মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলে, মেয়ের পক্ষ ছেলের বাড়ির আঙিনায় কয়টি খড়ের মাড়া আছে দেখতো। খড়ের মাড়া বেশি থাকলে ভাবতো যে, এ বাড়িতে মেয়েকে বিয়ে দিলে খেয়ে পড়ে সুখে শান্তিতে থাকবে। বর্তমানে যে বাড়িতে খড়ের মাড়া থাকে, সে বাড়িতে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। ভাবে যে, এ বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিলে মেয়েটি কাজ করতে করতে মরে যাবে। বর্তমানে মানুষ দেখে, বাড়ির আঙিনায় গ্যাসের রাইজার আছে কিনা, বাড়িতে WIFI এর সুবিধা আছে কিনা। বাসা বাড়িতে WIFI এর সুবিধা থাকলে বাসা ভাড়া হয়, না থাকলে বাসা ভাড়া হয় না। যে শীতের পিঠার মজা ছিল গ্রাম বাংলার মাটির চুলার আগুনের পাশে, সে পিঠার মজা চলে গেছে ফুটপাতে রাস্তার পাশে । আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থাও হয়েছে সেই রকম। আগে আমরা পড়ার টেবিলে ঘুমানোর জন্য কত-না মার খেয়েছি। এখনকার শিক্ষার্থীদের আর পড়ার টেবিলে ঘুমাতে দেখা যায় না। মোবাইল নামের আজব যন্ত্রটি হয়ে গেছে তাদের পড়ার টেবিল। এই আজব যন্ত্রটি আমাদের সন্তানদের চোখের ঘুমও কেড়ে নিয়ে গেছে। পিতা মাতার বকুনির ভয়ে ঘুমের ভান করে কম্বলের নীচেও আজব যন্ত্রটি নিয়ে ব্যস্ত থাকে আমাদের সন্তানরা। আজব যন্ত্রটি হাত থেকে নিয়ে গেলে কিংবা না দিলে অভিমানে আত্মহত্যা কিংবা বাড়ি থেকে বাহির হয়ে যাওয়ার ঘটনাও মাঝে মাঝে খবরের কাগজে দেখা যায়। আমার কাছে মনে হয়, মাদকের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে দাড়িয়েছে মোবাইলের নেশা। দিন দিন আমাদের সন্তানরা শিষ্টাচার, সামাজিকতা ভুলে যাচ্ছে। বাসায় কোন মেহমান আসলে, তাহার সাথে শিষ্টাচারের সাথে আলাপ চারিতা বাদ দিয়ে পাশের রুমে চলে গিয়ে মোবাইল নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। আবার এমন পরিবার ও আছে, বাবা, মা, সন্তান সবাই নিজ নিজ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কাহারো সাথে কাহারো কথা নাই। সবাই আজব যন্ত্রটি নিয়ে ব্যস্ত। কয়েক বন্ধু এক জায়গায় বসলে দেখা যায়, সবাই নিজ নিজ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। এই আজব যন্ত্রটি আমাদেরকে দিন দিন অসামাজিক বানিয়ে ফেলছে। বর্তমানে অনেক অসামাজিক অপরাধ, পরকীয়া, গোপন তথ্য ফাঁস, বিবাহ বিচ্ছেদ ও খুন সংঘটিত হওয়ার জন্য মোবাইল নামের আজব যন্ত্রটির ভূমিকা অনেকাংশে দেখা যায়। আমাদের সন্তানদের জীবন যাত্রা, লাইফ স্টাইল, গতিবিধি দেখলে খুব ভাবিত করে তোলে। (চলমান)

Exit mobile version