মহানবী (সা.)-এর আগমনের উদ্দেশ্য

মহান আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন ইবাদতের জন্য; মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন খলিফা হিসেবে। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা আহমাদ মুজতবা (সা.)–কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে: ‘তিনি মহান আল্লাহ, যিনি পাঠিয়েছেন তঁার প্রেরিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হিদায়াত (পথনির্দেশ) ও সত্য দ্বীন (জীবনবিধান) সহকারে; যাতে প্রকাশ্য বিজয়ীরূপে স্থাপন করতে পারেন দ্বীন ইসলামকে সব দ্বীনের (বিধান ও মতবাদ) ওপর; আর সাক্ষী ও সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা-৪৮ আল ফাত্হ, আয়াত: ২৮)।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে দুনিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে মহাগ্রন্থ আল কোরআন কারিমে বিভিন্ন সুরা ও আয়াত নাজিল করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সত্যসহ, সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে।’ (সুরা-২ আল বাকারা, আয়াত: ১২৯)। ‘আমি আপনাকে সুসংবাদ প্রদানকারী ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি।’ (সুরা-১৭ আল ইসরা/বনি ইসরাঈল, আয়াত: ১০৫ ও সুরা-২৫ আল ফুরকান, আয়াত: ৫৬)। ‘হে নবী (সা.)! নিশ্চয় আমি আপনাকে সাক্ষী, শুভ সংবাদ প্রদানকারী ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-৩৩ আল আহযাব, আয়াত: ৪৫)। ‘অবশ্যই আপনাকে আমি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-৩৫ আল ফাতির, আয়াত: ২৪)। ‘নিশ্চিতরূপেই আপনাকে আমি সাক্ষী, শুভ বার্তাবাহক ও সাবধানকারী হিসেবে পাঠিয়েছি।’ (সুরা-৪৮ আল ফাত্হ, আয়াত: ৮)।

এসব আয়াতে কারিমায় নবীজি (সা.)-এর আগমনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে তঁার দাওয়াতি কর্মপদ্ধতি সম্পর্কেও নির্দেশনা রয়েছে। তা হলো অসুন্দর, অন্যায়, অপরাধ ও মন্দ কাজের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করা এবং সুন্দর, ন্যায়, পরোপকার, কল্যাণকামিতা ও সত্কাজের শুভ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে মঙ্গল ও কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। যাতে মানুষ ইহজগতে চিরশান্তি, পরজগতে চিরমুক্তি, চিরকল্যাণ ও চিরমঙ্গল লাভ করতে পারে।

এ প্রসঙ্গে স্বয়ং প্রিয় নবী (সা.) বলেন: ‘আমি প্রেরিত হয়েছি মানবজাতির চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের নিমিত্তে।’ (তিরমিজি শরিফ)। এ জন্য প্রয়োজন ষড়্‌রিপু—কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য নিয়ন্ত্রণ করা। প্রিয় নবী (সা.) নিজে আরও বলেন: ‘আমি আসলে শিক্ষকরূপেই প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসলিম)। তাই তিনি হলেন বিশ্বশিক্ষক।

বিশ্বনবী (সা.)–কে আল্লাহ তাআলা শুধু দু-একটি ছোটখাটো মামুলি উদ্দেশ্য নিয়ে দুনিয়ায় পাঠাননি; বরং বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ কল্যাণের মহতী উদ্দেশ্যেই মহানবী (সা.)–কে এই জগতে পাঠানো হয়েছে। কোরআন মজিদে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ঘোষণা দিয়েছেন: ‘হে নবী (সা.)! আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা-২১ আল আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশেষ কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি; তিনি কোনো বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের জন্যও প্রেরিত হননি; তিনি প্রেরিত হয়েছেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য। রব্বুল আলামিন বলেন: ‘আর আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সমগ্র মানবতার জন্য সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী হিসেবে; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সুরা-৩৪ আস সাবা, আয়াত: ২৮)।

কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা জানতে ও বুঝতে পারি ইমামুল আম্বিয়া, সাইয়িদুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন আল্লাহর প্রিয় হাবিব, প্রিয় বন্ধু। আল্লাহর ভালোবাসা বা বন্ধুত্ব পেতে হলে প্রিয় নবী (সা.)-এর আনুগত্য স্বীকার করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে নবী (সা.)! আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে তোমরা আমার নবী (সা.)-এর অনুসরণ করো; তাহলেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৩১)। সহজে বলা যায়, রাসুল (সা.) এসেছিলেন আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি করতে। এ বিষয়ে নবী করিম (সা.) বলেন: ‘আমি আল্লাহর অতিপ্রিয় বন্ধু; গৌরব করি না।’ (বুখারি শরিফ)।

প্রিয় রাসুল (সা.) আল্লাহর রহমত ও দয়া-করুণার আধার ও মাধ্যম; তিনিই আল্লাহর রহমত বণ্টনকারী। এই মর্মে তিনি বলেন: ‘আমি বণ্টনকারী, আল্লাহ দাতা।’ (তিরমিজি শরিফ)। তিনি শাফায়াতে কুবরার অধিকারী। সেই মর্মে তিনি ঘোষণা করেন: ‘আমার উম্মতের বড় বড় গুনাহগার অপরাধীদের জন্যই আমি সুপারিশ করব।’ (সহিহ্ বুখারি শরিফ)। সুপারিশ লাভের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন: ‘যে আমার রওজা শরিফ জিয়ারত করল তার জন্য সুপারিশ করা আমার ওপর ওয়াজিব হয়ে গেল।’ (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

আল্লাহর প্রিয় হাবিব (সা.), মানবতার মহান বন্ধু, সুহৃদ ও সংস্কারক, কৌশলী সমাজবিজ্ঞানী ও দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক দুনিয়ায় এসেছিলেন মানবতার মুক্তির জন্য। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমগ্র মানবজাতির দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তঁার প্রিয় বন্ধুকে এই ধরায় প্রেরণ করেছিলেন। তাই এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, অশান্ত পৃথিবীতে স্বর্গীয় শান্তির সুবাতাস আনয়নের স্বার্থে মহানবী (সা.)-এর জীবনদর্শন অনুশীলন করা এবং তঁার আচার-আচরণ অনুসরণ করা একান্ত অপরিহার্য। এ জন্য প্রয়োজন তঁার জীবনচরিত তথা কর্মময় জীবনের ব্যাপক অধ্যয়ন ও বিপুলভাবে চর্চা করা। আর মহান এই রবিউল আউয়াল মাসই হলো এর উপযুক্ত ও শ্রেষ্ঠ সময়।

সব নবী-রাসুল (আ.) এই তিনটি গুণের অধিকারী। ১. মুন্তাখাব মিনাল্লাহ বা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত। তঁারা কোনো মানুষ দ্বারা মনোনীত নন। ২. মাসুম বা নিষ্পাপ। সব নবী-রাসুল (আ.) নবুওত ও রিসালাত প্রকাশের আগে বা পরে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, ছোট বা বড় কোনো প্রকার কোনো গুনাহ করেন নাই এবং করার সুযোগও নাই; কারণ তঁারা নবী বা রাসুল, তঁারা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত; তঁারা মাসুম বা নিষ্পাপ। ৩. সাহিবুশ শারিআহ বা বিধানপ্রণেতা। নবী রাসুলগণ (আ.) যা চাইবেন আল্লাহ তাআলা তা মঞ্জুর করবেন। যেমন: কিবলা পরিবর্তন (সুরা-২ আল বাকারা, আয়াত: ১৪৪) ও হাশরে শাফায়াতে কুবরা বা মহা সুপারিশের অধিকার (সুরা-৯৩ ওয়াদ দুহা, আয়াত: ৫)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Leave a Reply