Site icon Doinik Bangla News

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টিনৈপুণ্যের পরম প্রকাশ মানবজাতি। মানবই হলো আশরাফুল মখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। প্রথম মানব ও মানবী আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.)। সমগ্র মানবজাতি একই পিতা–মাতার সন্তান। সৃষ্টিতে ও মৌলিক গুণাবলিতে সব মানুষ যেসব অধিকার ধারণ করে, তাকেই বলে মানবাধিকার বা মানুষের মৌলিক অধিকার। যেমন স্বাভাবিক জন্মের অধিকার; বেঁচে থাকার বা স্বাভাবিক জীবনধারণের অধিকার; মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তু ও বিষয় তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা পাওয়ার অধিকার এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার। এসব অধিকার মহান আল্লাহ তায়ালাই মানুষকে দিয়েছেন। তাই সব মানুষ জন্মগতভাবেই এসব অধিকার লাভ করে থাকে। কোনো প্রকার আইনকানুন এর ব্যত্যয় ঘটালে তা কালাকানুন হিসেবে পরিগণিত হবে।

ইসলামে মানবাধিকার

মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। মানুষের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্যই আল্লাহ তায়ালা নবী–রাসুল পাঠিয়েছেন, কিতাব নাজিল করেছেন; শরিয়তের বিধান দিয়েছেন। ইসলামি শরিয়তের বিধানেও মানবাধিকার-সংক্রান্ত পঞ্চধারা প্রধান বিবেচ্যরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা জীবন রক্ষা, সম্পদ রক্ষা, বংশ রক্ষা, জ্ঞান রক্ষা ও ধর্ম রক্ষা। মূলত মানবতার সুরক্ষা বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই ইসলামের মূল লক্ষ্য ও মুখ্য উদ্দেশ্য।

মানবাধিকার ও বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবতার মুক্তির বারতা নিয়েই এ জগতে এসেছিলেন। তিনিই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সফল হয়েছিলেন। সে সময় ছিল ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা অন্ধকার যুগ। অজ্ঞানতা, পাপাচার, যুদ্ধবিগ্রহ, সহিংসতা, শিশুহত্যা ও কন্যাশিশুকে জীবন্ত মাটিচাপা দেওয়ার মতো অমানবিক প্রথার প্রচলন ছিল। ইসলামে মানবতাবিরোধী সব কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধকে ‘কবিরা গুনাহ’ বা মহাপাপরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এর জন্য দুনিয়ায় চরম শাস্তি ও পরকালে কঠিন আজাবের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

সব মানুষের সম-অধিকার

ইসলামের শিক্ষা হলো: সব মানুষ একই উপাদানে তৈরি, সবাই এক আল্লাহর বান্দা। সব মানুষ একই পিতা–মাতার সন্তান; সব মানুষ একই রক্তে-মাংসে গড়া; তাই সাদা-কালোয় কোনো প্রভেদ নেই। সব মানুষ আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উম্মত। কবরে ও হাশরে সবাইকে একই প্রশ্ন করা হবে। সুতরাং, সব মানুষের মানবাধিকার সমান।

বেঁচে থাকার অধিকার

আল্লাহ তায়ালা কোরআন মজিদে বলেন: ‘এ কারণেই বনি ইসরাইলের প্রতি আমি এই বিধান দিলাম যে, হেতু ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। তাদের নিকট তো আমার রাসুলগণ স্পষ্ট প্রমাণ এনেছিল, কিন্তু এরপরও তাদের অনেকে দুনিয়ায় সীমা লঙ্ঘনকারীই রয়ে গেল। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটিই তাদের লাঞ্ছনা এবং পরকালে তাদের জন্য মহা শাস্তি রয়েছে।’ (সুরা: ৫ আল মায়িদাহ, আয়াত: ২৭-৩৪)।

জীবনোপকরণ ও সম্পদের অধিকার

আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আল্লাহ তায়ালা (সৃষ্টিতে ও গুণাবলিতে) তোমাদের একের ওপর অন্যের যে প্রাধান্য দিয়েছেন, তা দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব জাহির কোরো না। প্রত্যেক পুরুষ তা-ই পাবে, যা সে অর্জন করে এবং প্রত্যেক নারী তা-ই পাবে, যা সে অর্জন করে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সব বিষয়ে অবগত আছেন।’ (সুরা: ৪ নিসা, আয়াত: ৩২)।

কেউ কারও সম্পদ যেন অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ না করে, সে জন্য বিধান দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব অপরাধীর সমান শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে।

জ্ঞানের সুরক্ষা ও শিক্ষার অধিকার

ইসলাম নারী-পুরুষ সবার জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘ইলম বা শিক্ষা গ্রহণ করা সব নারী ও পুরুষের ওপর ফরজ কর্তব্য।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। জ্ঞানের সুরক্ষার জন্য সব ধরনের মাদকদ্রব্য হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘হে বিশ্বাসী মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু; শয়তানের কর্ম। সুতরাং, তোমরা তা বর্জন করো; যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’

বংশ, পবিত্রতা ও সম্মান সুরক্ষার অধিকার

সভ্য মানুষ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য এবং সুসভ্য সমাজ ও সংস্কৃত জাতির পূর্বশর্ত হলো আত্মীয়তার বন্ধন, বৈবাহিক সম্পর্ক ও দাম্পত্য জীবন। এখানেও নারী-পুরুষ উভয়ের যথাযথ ভূমিকা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে; পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনের সুযোগ এবং প্রস্তাব গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের এখতিয়ারও রয়েছে। (সুরা: ২ বাকারা, আয়াত: ২৩০)।

ধর্মকর্মে সম-অধিকার

আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘যে মন্দ কাজ করবে, সে অনুরূপ ছাড়া বিনিময় পাবে না। আর যারা সৎ কর্ম করবে, তারা পুরুষ হোক বা নারী হোক, যদি তারা বিশ্বাসী হয়, তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা সেখানে বেহিসাব রিজিক পাবে।’ (সুরা: ৪০ মুমিন, আয়াত: ৪০)।

ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও অর্জন এবং ইসলাম সুরক্ষা মানে হলো মানবাধিকারের সুরক্ষা ও বাস্তবায়ন। নারী ও শিশু, বিশেষত কন্যাশিশু এবং অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মানবাধিকার সুরক্ষা করা সচেতন ও সামর্থ্যবান সব নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। সব মুসলমানের ইমানি কর্তব্য।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।

Exit mobile version