Site icon Doinik Bangla News

লাভের আশায় শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়া খেলায়, পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের টাকা

মোঃ কাশেদুল হক কাজলঃ মোবাইল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের কল্যাণে অনলাইনে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া খেলা। অল্প টাকায় বেশি আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে জুয়াড়ি চক্রের শতাধিক ওয়েবসাইট (বেটিং সাইট) বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ শিশু কিশোর শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করছে সর্বনাশা অনলাইন জুয়া খেলায়, পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।  অভিভাবকের অজান্তে শিশু কিশোররা মাদকের মতো ভয়ংকর অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে খুব দ্রুত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
চক্রের সদস্যরা প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন করছেন। যার পরিমাণ বছরে হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব জুয়ার লেনদেনে ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) অ্যাপ এবং কিছু ব্যাংকের অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাপ ও কার্ড, যা উদ্বেগজনক বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ধরনের ১০টি বেটিং সাইট চিহ্নিত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে, যেখানে জুয়ার অর্থ পরিশোধে এমএফএস ও ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহারের তথ্য মিলেছে। সর্বনাশা জুয়ায় দেশের মোবাইল আর্থিক সেবার অ্যাপসগুলো শুধু ব্যবহৃতই হচ্ছে না, এমএফএসগুলোর মাধ্যমে জুয়ার প্রতিষ্ঠানকে ‘মার্চেন্ট’ হিসেবে অন্তর্ভুক্তি (অনবোর্ড) করার ঘটনাও ঘটছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি ও সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী  বলেন, এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়েই নানা কথাবার্তা হচ্ছে। তাই শুধু সতর্ক বা নির্দেশনা দিলেই হবে না, এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো তা ঠিকমতো পরিচালনা করছে কিনা সেটিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মনিটরিং করতে হবে। এজেন্টসহ কেউ জড়িত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে।
যেভাবে চলছে অনলাইন জুয়া : এক্ষেত্রে ডলার কেনাবেচা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে না। সব সময় বিকাশ, রকেট ও নগদের মাধ্যমে লেনদেন ও বেট নিতে পারবেন। এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাংকের কার্ড থেকেও লেনদেন করা যাবে। কয়েন জিতলেই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিতে পারেন। কারও কাছে কয়েন বিক্রির জন্য বসে থাকতে হবে না। এজেন্ট থেকে আপনার বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ সরাসরি চলে যাবে। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে ‘সেভেন উইকেট ডটকম লাইভ’ নামে একটি সাইটে জুয়াড়ি চক্রের সদস্যরা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে ছড়িয়ে দিয়েছে জুয়ার নেশা। এ ধরনের শতাধিক বেটিং সাইট সক্রিয় রয়েছে দেশে, যেগুলো সাইটে ভার্চুয়ালি জুয়া খেলে অল্প টাকা বিনিয়োগে বেশি আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অধীনস্থ সুপার এজেন্টদের মাধ্যমে স্থানীয় এজেন্ট বা মাস্টার এজেন্ট নিয়োগ করে থাকে। ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা জামানত রাখা সাপেক্ষে এজেন্ট হওয়া যায়। এসব এজেন্ট জুয়ায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের ভার্চুয়াল চিপস বা কয়েন সরবরাহ করে। সেই চিপস বা কয়েন দিয়ে জুয়া খেলা হয়।
জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব সাইটে জুয়া পরিচালনা করা হয় তার বেশিরভাগই দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন অনলাইন জুয়া খেলায় দেশে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। আন্তর্জাতিক এক পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে মানুষ যে পরিমাণ অর্থ জুয়া খেলায় হারিয়েছেন, তার পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানান- মোবাইল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের কল্যাণে অফিস ও ঘরে বসেই অনেকে অনলাইন জুয়া খেলছেন। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচেও ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়ার এ ভয়াবহতা। সর্বনাশা এ নেশায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ১০০টির বেশি বেটিং ওয়েবসাইট ও অ্যাপস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সারাদেশে অবৈধ অনলাইন জুয়া কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইট ও অ্যাপস বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার এসএম আশরাফুল আলম বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার বেশকিছু সাইট সক্রিয় থাকার তথ্য আমরা পেয়েছি। দেশের বাইরে থেকে এসব সাইট পরিচালনা করা হচ্ছে।’
সূত্রগুলো বলছে, যখনই জুয়া খেলার কোনো সাইট শনাক্ত হয় বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে তখনই তা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) মাধ্যমে ব্লক বা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের দুই শতাধিক সাইট বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, সাইটগুলো নাম বদল করে বা মূল সাইটের কাছাকাছি নাম দিয়ে আবার ফিরে আসছে। আবার বন্ধ করা অনেক সাইট প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে তাদের খেলা চালাচ্ছে।
সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনলাইন গ্যাম্বলিং সাইট বেটওইনার ডটকম পরিচালনাকারী তিনজন বাংলাদেশি এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে (সিআইডি)। সিআইডি জানায়, রাশিয়া থেকে পরিচালিত বেটওইনার সাইটে জুয়ায় অংশগ্রহণকারীদের টাকা ‘বাইন্যান্স’ নামে মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাপের মাধ্যমে মার্কিন ডলারে কনভার্ট করত আটককৃত ব্যক্তিরা। পরবর্তীতে ওই অ্যাপসের মাধ্যমে এই টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যায়।

Exit mobile version