লিখি পদ্য, মুহূর্তের আলো

নতুন বছরে নতুনের আবাহনে সবাই নিজের মুখোমুখি হন, করেন নতুন পরিকল্পনা। লেখকেরাও এর বাইরে নন। এই আয়োজনে মহাদেব সাহা লিখেছেন ২০১৮ সালে লেখালেখি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা

আমি ঠিক অতটা পরিকল্পিত জীবনের মানুষ নই, লেখালেখির বেলায়ও তাই। সাধারণত লিখি পদ্য, তাকে বলা যায়, মুহূর্তের আলো, পরিকল্পনা করে হয় না। ছক তৈরি করে, কী কী লিখব ঠিক করে কখনো লিখতে বসিনি, পদ্য লেখা বোধ হয় এ রকমই, এভাবেই হয়, হলে হয়, না-হলে না হয়। যে লেখে পদ্য, তার আবার পরিকল্পনা কী? ওসব কিছু না। আমার জীবনটাও এ রকমই। এমনি করেই দিন গেল।

এখানে একটু শৈশবের কথা বলি, আমার কবিতা লেখার শুরুর দিককার কথা। গ্রামের এক বালিকা বিদ্যালয়ে একদিন পড়ালেখায় হাতে-খড়ি হয়েছিল আমার। যদিও নামে সেটি ছিল বালিকা বিদ্যালয়, কিন্তু সেখানে ছেলেমেয়ে সবাই একসঙ্গে পড়াশোনা করত। এখান থেকে পাস করলাম মাধ্যমিক। ভর্তি হলাম গ্রামেরই উচ্চবিদ্যালয়ে। পরে চলে এলাম বগুড়ার ধুনট উচ্চবিদ্যালয়ে। এখানকার লাইব্রেরিতে ছিল প্রচুর বই। ঢুকে পড়লাম অবারিত বইয়ের রাজ্যে। এই রাজ্যে গমনের মধ্য দিয়েই তো আমার পাঠাভ্যাস গড়ে উঠল। সেই পরম্পরায় বাড়ির সবার ও বন্ধুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে একের পর এক কবিতা লিখে ভরিয়ে তুললাম খাতা। এই যে ঘটনাগুলো ঘটল, এসব তো পরিকল্পনা করে হয়নি। কবিতা আসত—এখনো ওইভাবেই আসে—মগ্নতার হাত ধরে।

আমি বরং বলতে পারি, ভবিষ্যৎ ভাবনার থেকে অতীতের দিকেই আমার চোখ থাকে বেশি। মনে হয়, যা করেছি, সবই ভুল। এই অতীত-ভুল নিয়েই আমার ভাবনা; কত যে ভুল—জীবনটাই যেন ভুলসমগ্র! তবু সব মানুষের কিছু-না-কিছু ইচ্ছে হয়, মনটা একটা কিছু করতে তো চায়ই। সে হয়তো তেমন পষ্ট কিছু নয়; আবছা, অস্পষ্ট। মাঝে মাঝে আমার এমন ইচ্ছে তো হয়ই,কিন্তু সে আর কী হলো, সে আর কী হবে?

দিনপঞ্জি বদল হয়ে নতুন একটা বছর শুরু হয়েছে। সময় আমার কিছু করা বা না-করার জন্য থেমে থাকবে না। আর কী-ই বা এমন করার আছে, লেখার আছে, এ নিয়ে খুব বেশি ভাবিও না। আসলে এত ভেবেই বা হবেটা কী?

কিন্তু নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের ক্ষণ থেকেই নিত্যনতুন পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায় সবার মধ্যে। আমার কাছেও অনেকে জানতে চান, নতুন বছরে পরিকল্পনা কী? এমন প্রশ্নে আমি কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়ি। কারণটা আগেই বলেছি, অত ভেবে তো কিছু করিনি জীবনে।

তবে একেবারেই যে ভাবিনি, ভাবি না, এমন বললে তা-ও হবে সত্যের অপলাপ। লেখালেখি নিয়ে এ বছর আমার সামান্য যা ভাবনা তা এমন: শিশুদের জন্য একটি শিশুপাঠ্য বই লিখতে চাই, একটু অন্যরকমভাবে। এই কাজটা করতে পারলে সুখবোধ করব। আত্মজীবনী মানে কবিতার জীবন লিখতে শুরু করেছিলাম; এবার সেটি শেষ করতে চাই। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যা কিছু দেখেছি, সেই সব স্মৃতিকে সম্বল করে লিখতে শুরু করেছি আত্মস্মৃতি ১৯৭১ নামে একটা বই, এ বছর সেটি যদি শেষ করতে পারি, তবে খুশির সীমা থাকবে না। মোটামুটিভাবে ২০১৮ সালে এই তো আমার লেখালেখির কাজ, তালিকা তৈরির মতো কিছু নয়। আর এটিও বলে রাখি, এ বছর এই কাজগুলো হলে হবে, না-হলে না হবে। আমার কাজ তো পদ্য লেখা, সে তো চলছেই—তা নিয়েই আমি খুশি।

গত বছর আমি তিন শতাধিক গান লিখেছি, বাংলা গানের পঞ্চকবির ধারায়। বলা যায়, গানের মধ্যেই ডুবে ছিলাম গেল বছর। সেই সব গান নিয়ে আমার গান শিরোনামে এ বছর একটি বই বের করবে মাওলা ব্রাদার্স। একই প্রকাশনী থেকে এবার আমার একটি কবিতার বইও বেরোবে, নাম কোন মন্ত্রবলে অন্ধকারে আলো জ্বলে। এ ছাড়া অনন্যা থেকে প্রকাশিত হবে আরও দুটি বই—কাব্যগ্রন্থ অনন্তের বাঁশি ও গদ্যসমগ্র ৩।

বছরের পরিকল্পনা এটুকুই। আবারও বলি, পরিকল্পনা করে কবিতা লেখা যায় না। কবিতা এমনিতেই হয়, হয়ে ওঠে।

Leave a Reply