স্বাধীনতার ৫১ বছর;অদম্য অগ্রযাত্রায় কতটুকু?

স্টাফ রিপোর্টঃ

১৯৭১ থেকে ২০২২। ৩০ লাখ শহিদের রক্ত দিয়ে আঁকা আবেগ ও ভালোবাসায় পূর্ণ, লাল-সবুজের মানচিত্রের একান্ন বছর। শোষণ-বঞ্চনার শিকল ছিঁড়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর বাংলাদেশ।
এটি শুধু একটি দেশের স্বাধীনতাই নয়, শোষকদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণাও বটে। শুধু তাই নয়, কীভাবে একটি নিরস্ত্র জাতি শুধু মনোবলের জোরে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে হার মানাতে পারে-তা সারাবিশ্বে নজির সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। কিন্তু ৫১ বছরে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে দেশ অনেক এগোলেও আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি রাজনীতিতে। দেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি প্রতিরোধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন। অর্থ পাচার রোধ, সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
অর্থনীতির আকারে বর্তমান বিশ্বে ৪০তম বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বিশ্বব্যাংক থেকে স্বীকৃতি মিলেছে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার। এসব অর্জন বাংলাদেশের সক্ষমতার পাশাপাশি মর্যাদাও বাড়িয়েছে।
বর্তমানে ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, তৈরি পোশাকে দ্বিতীয়, পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, কাঁঠালে দ্বিতীয়, চাল, মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ, আম ও আলুতে সপ্তম, ক্রিকেটে, আউটসোর্সিং ও বাইসাইকেল রপ্তানিতে অষ্টম, পেয়ারায় অষ্টম এবং মৌসুমি ফল উৎপাদনে দশম অবস্থানে বাংলাদেশ।
এ অর্জন শহিদদের জানান দেয়, তোমাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ৫১ বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ সেই স্বপ্ন পূরণের নাম বাংলাদেশ।
তবে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্জনের তালিকা দীর্ঘ। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি বেশি। এর অন্যতম হলো দারিদ্র্য বিমোচন।
কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। তবে এ দুই খাতে সামগ্রিক গুণগত মান আরও উন্নতি করা জরুরি।
এছাড়া মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নারীর ক্ষমতায়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বড় বড় ভৌত অবকাঠামো অর্জনের পাল্লাকে অনেক ভারী করেছে। আরও আছে নিজস্ব স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন চলমান মেগা প্রকল্প।
আর সবকিছুকে ছাপিয়ে ক্রিকেটের অবিশ্বাস্য উন্নতি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে নতুনরূপে পরিচিতি দিয়েছে। এসেছে বিশ্ব শান্তিতে নোবেলও। এখন ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই দেশটি এখন বিশ্বে উন্নয়নের ‘রোড মডেল’।
তবে সামনের দিনগুলোতে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সম্পদ, আয় এবং ভোগের ক্ষেত্রে সীমাহীন বৈষম্য রয়েছে। মোট সম্পদের প্রায় ৫২ শতাংশই উচ্চ শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের হাতে। আর নিম্ন শ্রেণির ৫ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র দশমিক ০৪ শতাংশ।
দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থ পাচার বন্ধ করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত করাই হবে মূল কাজ। এগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব কমানো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামগ্রিতভাবে পরিমাণগত সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে। এর সুফল সবার কাছে পৌঁছানো জরুরি। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ৫১ বছরে দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
স্বাধীনতার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে কিছু থাকবে না। সেখান থেকে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
এর মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, প্রাথমিক শিক্ষা এবং নারীশিক্ষাসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বিশাল অর্জন হয়েছে। এছাড়া ইতোমধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণে সুপারিশ মিলেছে।
সেখানে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বেশ ভালো অবস্থান। তবে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। কারণ অর্জনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রপ্তানি।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের রপ্তানি খাত গার্মেন্টনির্ভর। কোনো কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যটি মার খেলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় আসবে। এ খাতে রপ্তানিতে পণ্যের বহুমুখীকরণে জোর দিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
এছাড়া অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য অনুসারে প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এটি রোধ করা জরুরি। অন্যদিকে দেশের আর্থিক খাত অত্যন্ত দুর্বল।

ব্যাংক ও পুঁজিবাজার দুই খাতের অবস্থাই খারাপ। দুই খাতে ব্যাপক সংস্কার জরুরি। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাধীনতার ৫১ বছরেও ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতিতে চূড়ান্ত করা যায়নি।

Leave a Reply