কুয়েটের ক্যাডারস ক্লাব

খুলনা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে শহরের গন্ধ যেখানে পৌঁছায় না, সেখানেই খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের রশিদ হলের পাশে সীমানা নির্দেশক দেয়ালে জায়গা করে নিয়েছে ছোট্ট একটা ‘পকেট গেট’। এই গেট পেরোলেই চায়ের দোকানগুলো, যেখানে কুয়েটিয়ানদের আড্ডা বসে। এসব আড্ডা থেকে বেরিয়ে আসে দারুণ সব প্রকল্প বা উদ্ভাবনের ভাবনা। এমনই এক আড্ডায় বসে হঠাৎ ইভান আহমেদের মাথায় এসেছিল ‘আইডিয়া’টা। কুয়েটের ২০০৮ ও ২০০৯ ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী মিলে খুলেছিলেন ‘কুয়েট ক্যাডারস ক্লাব।’

কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন বা ক্যাড হলো কম্পিউটার সফটওয়্যারের সাহায্যে কোনো কিছুর নকশা তৈরি করা, তার পরিমার্জন, বিশ্লেষণ করা। এই ক্যাডের সঙ্গেই সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয় কুয়েটের ‘ক্যাডারস’ ক্লাবটি। শিল্পায়নের এই রোমাঞ্চকর যুগে কোনো যন্ত্র তৈরি করার আগে দরকার তার একটি ত্রিমাত্রিক নকশা। এই কাজ করা হয় ক্যাডের মাধ্যমে। ‘কথাবার্তা শুনে কাঠখোট্টা ধরনের কিছু মনে হলেও কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। আমাদের এই ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়েছিল মেকানিক্যাল বিল্ডিংয়ের সামনে একটি ত্রিমাত্রিক আলপনার মাধ্যমে। আমাদের উদ্দেশ্য এই ব্যাপারটার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো, ব্যাপারটা সবার কাছে সহজভাবে তুলে ধরা’, বলছিলেন ক্লাবের সদস্য ওয়াসিফ হাসান। কুয়েট ক্যাডারস কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যে বেশ সফলই বলতে হবে। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি।

‘কম্পিউটার বিষয়ে যাঁদের খুব ভালো দক্ষতা নেই, তাঁদের জন্য কি কাজটা কঠিন…’ প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই হাত নেড়ে থামিয়ে দিলেন ক্লাবের সদস্য ফুয়াদ হাসান। ‘আমাদের এই ক্লাবে আসতে হলেই আপনাকে সবকিছু জেনে আসতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এমনকি যারা কিছু জানে না, তারাও এই ক্লাবে আসে। ক্লাবের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের একটি পরিবার বলতে পারেন।’ নতুনদের হাতেখড়ির উপায়টা জানতে চাইলে যন্ত্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আহমেদ জাওয়াদ বলেন, ‘শুরুতেই আমরা অটোক্যাড ও সলিডওয়ার্কস—এই দুটি ডিজাইন সহায়ক সফটওয়্যারের ওপর দুটি কর্মশালার আয়োজন করি। দুই ব্যাচে ৯০ জন করে এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করতে পারে। দিন দিন অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। ৯০ জনের সিট শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেকে এসে তাঁদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেন।’

জানা গেল, সারা বিশ্বে যাঁরা ‘ক্যাড’ নিয়ে কাজ করছেন, অনলাইনে তাঁদের একটা দল আছে। এই দলটির নাম গ্র্যাবক্যাড। গ্র্যাবক্যাডে বাংলাদেশি ক্যাডারদের মধ্যে প্রথম দশজনই কুয়েট ক্যাডারসের সদস্য। দেশীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আধিপত্য বিস্তার করছে ক্লাবটি। টেকফেস্ট বাংলাদেশ ২০১৭-এর ক্যাডাথন পর্ব, আইইউটিতে অনুষ্ঠিত মেক্সিলারেশন, বুয়েট যন্ত্রকৌশল বিভাগ আয়োজিত ক্যাড কনটেস্ট—সব প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান আছে এই ক্লাবের সদস্যদের দখলে।

কথা হলো ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইভান আহমেদের সঙ্গে। বললেন, ‘মেকানিক্যাল ড্রয়িং ব্যাপারটা শিক্ষার্থীরা একটু ভয় পায়। আমাদের এই ক্লাব খোলার পেছনের উদ্দেশ্য ছিল, সফটওয়্যারের সাহায্যে এই মেকানিক্যাল ড্রয়িংয়ের ভীতি দূর করা। বাংলাদেশে শিল্পায়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। একসময় বাংলাদেশও গাড়ি কিংবা বড় কলকারখানার যন্ত্রপাতি তৈরি করতে শুরু করবে। তখন আমাদের অনেক ডিজাইনার লাগবে। ক্লাবটা খোলার সময় ভাবিনি ক্লাবটা এত বড় হয়ে যাবে। একদিন এই ক্লাব হয়তো শুধু কুয়েটের মধ্যেই থাকবে না, যাঁরা ক্যাড পছন্দ করেন, তাঁদের সবার জন্য একটা দারুণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে।’

আড্ডার ইতি টানলেন ক্যাডারসের বর্তমান প্রধান নির্বাহী মাকসুদুল আলম, ‘অনলাইনেও আমরা কাজ করি। আমাদের মূল লক্ষ্য দেশের সব ক্যাড নিয়ে উৎসাহী মানুষজনকে এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা। আমাদের ফেসবুক গ্রুপের সদস্যের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। আমাদের লক্ষ্য, একদিন এই ক্লাবকে একটা ক্যাড সলিউশন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো, আমাদের সবার সৃষ্টিশীলতাকে একসঙ্গে কাজে লাগিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া…’

Leave a Reply