গ্রেপ্তার এড়াতে যেভাবে রাত কাটান ‘বালুখেকো’ সেলিম খান

সাড়ে ৩৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সেলিম খানকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ ছিল হাইকোর্টের। কিন্তু চাঁদপুরের একটি ইউনিয়নের বিতর্কিত এই চেয়ারম্যান আত্মসমর্পণ করেননি। এখন গ্রেপ্তার এড়াতে নানা জায়গায় শরণ নিয়ে আত্মগোপনে থাকছেন তিনি।

মূলত সেলিম খানের এই পলাতক জীবন চলছে গত আগস্ট থেকে। সদর চাঁদপুরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে চলে যান এই চেয়ারম্যান। কখনো নিজ বাড়ি, কখনো আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি, কখনো নদীতে নৌকায় রাতের পর রাত কাটাচ্ছেন তিনি।

গত ৪ সেপ্টেম্বর নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের দিন ঠিক করা ছিল। এর তিন সপ্তাহ আগে ১৪ আগস্ট হাইকোর্ট এই তারিখ নির্ধারণ করেন। কিন্তু নানা বাহানা করে তিনি আর আত্মসমর্পণ করেননি।

তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হওয়ার আগেই ঢাকা ছাড়েন তিনি। আস্তানা গাড়েন নিজ ইউনিয়নে। মাঝে একবার সবার দৃষ্টি এড়িয়ে ঢাকার অফিসে এলেও তড়িঘড়ি করে আবার ফিরে যান এলাকায়।

এর আগে বেশ কিছুদিন তার কোনো খোঁজ ছিল না। আগস্টের ১২-১৩ তারিখের দিকে গ্রামের বাড়িতে চলে যান বলে খবর পাওয়া যায়। এরপর আবার শুরু হয় আত্মগোপনে থাকা।

দুদক মামলা করার পর সেলিম খান গত জুলাই মাসের শেষ সময়ে আত্মগোপনে গেলে রাজধানীর কাকরাইল ও নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড়ের অফিসে থেমে যায় কর্মচাঞ্চল্য। কাকরাইলের খান টাওয়ারের গলিটি একসময় চলচ্চিত্র জগতের কলাকুশলীদের পদচারণে মুখরিত থাকলেও এখন অনেকটাই নীরব। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড়েও শ্মশানের নীরবতা। যেখানে একসময় লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের মাধ্যমে তৈরি হতো নতুন নতুন সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ, সেলিম খান না থাকায় সেখানে থমকে আছে সব কাজ।

কাকরাইল অফিসে সরিজমিনে গিয়ে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা একজন বয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, সেলিম খান ব্যক্তিগত কিছু কাজে ঢাকার বাইরে আছেন।

অনেক দিন ধরে অফিসে না এলেও সবার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে জানিয়ে ওই নিরাপত্তা কর্মী বলেন, ‘কিছুদিন আগে একবার এসেছিলেন কিছু সময়ের জন্য। আবার চলেও গেছেন।’

ইতোমধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেলিম খানের মালিকানাধীন ওটিটি ফ্ল্যাটফর্ম সিনেবাজ অ্যাপস। নিভু নিভু করে চলছে সরকারের অনুমোদন পাওয়া আইপি টেলিভিশন ‘ভয়েস টেলিভিশন’। কার্যক্রম নেই সিনেমা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়ারও।

জানা গেছে, দুদকের মামলা হওয়ার পর থেকে সেলিম খানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের বেতন-ভাতা অনিয়মিত। এর আগে গত দুই ঈদে দেওয়া হয়নি বোনাসও।

সেলিম খানের সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যরাও চাঁদপুরের সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুরের বাড়িতেই অবস্থান করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুদকের মামলা হওয়ার আগেই সপরিবারে ঢাকা ছাড়েন সেলিম খান। সেই থেকে এলাকাতেই বসবাস করছেন তিনি। বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী শাহানা বেগম, বড় ছেলে চিত্রনায়ক শান্ত খান, ছোট ছেলে শাহিন খান এবং বড় মেয়ে সেলিনা খান। ছোট মেয়ে পিঙ্কি আক্তার রয়েছেন ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে।

সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সেলিম খানকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। এর মধ্যে নিজের প্রভাব খাঁটিয়ে এখনো ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দাবি করে এলাকায় দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন।

এদিকে সেলিম খানের ছেলে চলচ্চিত্র অভিনেতা শান্ত খানের প্রায় ১৫ কোটি টাকার সন্দেহজনক স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজ পায় দুদক। এসব সম্পদের সত্যতা নিশ্চিত করতে ৫৮টি দেশি-বিদেশি ব্যাংকের এমডি ও সিইওর কাছে চিঠিও পাঠানো হয়। দুদকের এমন অনুসন্ধানের কিছুদিন আগে থেকেই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন শান্ত খান।

অনেকগুলো সিনেমায় কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ থাকলেও সেগুলো শাপলা মিডিয়ার হওয়ায় এবং শাপলা মিডিয়ার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় গ্রামে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ক্রিকেট খেলে সময় পার করছেন তিনি। মাঝে মাঝে মোটরবাইকের বহর নিয়ে এলাকায় মহড়া দিতেও দেখা যায় শান্ত খানকে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাসের শেষ দিক থেকেই গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সেলিম খান। শুরুতে কিছুদিন মতলবের মোহনপুর পর্যটন কেন্দ্রে আত্মগোপনে থাকলেও সেখানে থাকার বিষয়টি অনেকেই জেনে যাওয়ায় সেখানে থাকা নিরাপদ মনে করেননি। পরে সেখান থেকে চলে যান নতুন স্থানে। এরপর কিছুদিন কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া না গেলেও আগস্টের ১২-১৩ তারিখের দিকে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এরপর আবার শুরু হয় আত্মগোপনে থাকা। কখনো গ্রামে নিজ বাড়ি, কখনো আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি, কখনো নদীতে নৌকায় রাতের পর রাত কাটাচ্ছেন তিনি।

এভাবেই দুদকের দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টের আত্মসমর্পণের নির্দেশনা অমান্য করে নিজ এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন চাঁদপুরের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত চেয়ারম্যান সেলিম খান।

ঢাকা মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু সংবাদ মাধ্যমকে  জানান, সেলিম খান হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে আদালতকে অবমাননা করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি এখন ফেরারি। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে যাওয়ার কথা।

দুদকের পিপি মাহমুদ জাহাঙ্গীর   জানান, তিনি (সেলিম খান) যদি সারেন্ডার না করেন তাহলে আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবে। এ ছাড়াও আমরা সেলিম খানের মালামাল ক্রোকের জন্য আবেদন করেছিলাম, সে বিষয়ে গত রবিবার শুনানি হয়েছে। আদালতে আদেশ হলে তার সম্পদ ক্রোক করা হবে।’

সূত্রঃ ঢাকা টাইমস

Leave a Reply