Site icon Doinik Bangla News

ছয়তলা বাড়ি, প্লটসহ কোটি টাকার জমি ও দুটি বাসের মালিক ওসির স্ত্রী

ক্রাইম রিপোর্টঃ চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার এলাকায় কোটি টাকা মূল্যের ছয়তলা বাড়ি। কক্সবাজার সদরে প্লটসহ কোটি টাকার জমি। রয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীবাহী দুটি বাসও।

এসব সম্পত্তির মালিক ফেরদৌসী আকতার নামের এক গৃহিণী। তাঁর স্বামী মো. শাহজাহান শিল্প পুলিশ চট্টগ্রামের পরিদর্শক। এর আগে তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া ও সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, স্বামী পুলিশ কর্মকর্তার ‘ঘুষ ও দুর্নীতির’ মাধ্যমে এসব সম্পদের মালিক হন স্ত্রী ফেরদৌসী আকতার। তাঁর ৩ কোটি ২৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া ফেরদৌসী নিজেকে মৎস্য ও পোলট্রি খামারি দাবি করলেও এগুলোর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

মামলা হওয়ার পর আসামিরা ঘুষের টাকায় অর্জিত এসব সম্পদ হস্তান্তর কিংবা স্থানান্তর করতে পারেন। এ জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন করা হয় ক্রোকের জন্য। ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুন নেসা সম্পদগুলো ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন।

ফেরদৌসীর স্বামী মো. শাহজাহান ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ পুলিশে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লালমাই থানার কাতালিয়া এলাকায়। চাকরির শুরুতে তিনি বেতন পেতেন ২ হাজার ৬০০ টাকা। বর্তমানে শিল্প পুলিশ চট্টগ্রামে পরিদর্শক হিসেবে তিনি বেতন পান ৬০ হাজার টাকা।

বেতন–ভাতার বাইরে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠায় অনুসন্ধানে নামে দুদক। এতে শাহজাহানের অবৈধ সম্পদ পাওয়া যায় ৭৮ লাখ টাকার। এ কারণে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের উপপরিচালক রতন কুমার দাশ বাদী হয়ে মামলা করেন। এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসীর অবৈধ সম্পদের তথ্য। এরপর চলতি বছরের জুলাই মাসে স্বামী–স্ত্রী দুজনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মামলাটি হয়।

দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক বলেন, মামলা হওয়ার পর আসামিরা ঘুষের টাকায় অর্জিত এসব সম্পদ হস্তান্তর কিংবা স্থানান্তর করতে পারেন। এ জন্য দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে আবেদন করা হয় ক্রোকের জন্য। ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুন নেসা সম্পদগুলো ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন। দুদক জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এসব সম্পদ ক্রোকের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

ওসির স্ত্রীর যত সম্পদঃ 

ওসি শাহজাহানের স্ত্রী ফেরদৌসী আকতারের ছয়তলা বাড়িটির অবস্থান চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানার লালখান বাজার এলাকায়। নগরের ওয়াসা মোড় থেকে তিন শ গজ পশ্চিমে হাই লেভেল সড়কে বাড়িটির অবস্থান। সবাই এটিকে ওসি শাহজাহানের বাড়ি নামে চেনে।

১১ সেপ্টেম্বর সরেজমিন দেখা যায়, বাড়িটির পাঁচতলা পর্যন্ত রয়েছে ১০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। নিচতলায় আছে একটি ফ্ল্যাট ও বাকি অংশে পার্কিং। এর মধ্যে তৃতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন শাহজাহান।

২০০৩ সালে পাঁচ শতক জায়গা কিনে বাড়িটি তৈরি করা হয়। দদুকের অনুসন্ধানে জমি ও ভবন নির্মাণের খরচ ধরা হয় ৮৬ লাখ ২১ হাজার টাকা। জানতে চাইলে লালখান বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বলেন, লালখান বাজারের হাই লেভেল সড়কে জায়গাসহ ভবনটির বর্তমান বাজারদর পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা।

ফেরদৌসী কক্সবাজার সদর থানার ঝিলংজা মৌজায় ২০১৫ সালে চার কাঠার একটি প্লট কেনেন, যার মূল্য ৬০ লাখ ৩১ হাজার টাকা। এ ছাড়া ২০১৬ সালে কেনা ঝিলংজা মৌজায় ২০ শতক জমি রয়েছে তাঁর নামে, যার মূল্য ১ কোটি ৫৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। একই মৌজায় ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকায় ২ শতক জঙ্গলবেষ্টিত জমি কেনেন ফেরদৌসী।

বাড়ি–জমির পাশাপাশি দুটি যাত্রীবাহী বাসের মালিকও ফেরদৌসী। এগুলো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডে চলাচল করে। ২০১৪ সালে ফেরদৌসী ১০ লাখ টাকায় এই দুটি বাস কেনেন বলে জানায় দুদক।

অস্তিত্বহীন পোলট্রি ও মৎস্য খামারে ‘আয়’

দুদক জানায়, ২০০৬-০৭ থেকে ২০১৯-২০ কর অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ বছরে ফেরদৌসী আকতার পোলট্রি ও মৎস্য খামার থেকে আয় দেখান ২ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু ব্যবসা–সম্পর্কিত ট্রেড লাইসেন্স ব্যতীত অন্য কোনো কাগজপত্র তিনি দেখাতে পারেননি।

সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্র, মৎস্য ও পোলট্রি খামারে বৈদ্যুতিক মিটার সংযোগ থেকে শুরু করে যাবতীয় কাগজপত্র, পরিবেশের ছাড়পত্র, খামারের লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাংক হিসাব, মালামাল কেনাবেচার বিল–ভাউচারসংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

এ বিষয়ে ফেরদৌসী আকতারের বক্তব্য জানতে ১১ সেপ্টেম্বর বাসায় গেলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। পরে তাঁর স্বামী পুলিশ পরিদর্শক মো. শাহজাহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, পোলট্রি ও মৎস্য ব্যবসা রয়েছে স্ত্রীর।

তাঁর স্ত্রীর আত্মীয়স্বজন দেশের বাইরে থাকেন। তাঁরা টাকা পাঠিয়েছেন। সেই টাকায় স্ত্রী এসব করেছেন। এ ছাড়া বেতন থেকে কিছু টাকা তিনি স্ত্রীকে দিতেন।

তবে পোলট্রি ও মৎস্য খামারের অবস্থান কোথায় তা জানাতে পারেননি তিনি। এখন দুদকের মামলা আইনগতভাবে মোকাবিলা করবেন বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

শাহজাহানের ঘুষের টাকা বৈধ করতে স্ত্রীকে মৎস্য ও পোলট্রি ব্যবসায়ী সাজালেও এগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁদের আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো তদন্ত করা হচ্ছে।

দুর্নীতিবাজেরা স্ত্রীদের পোলট্রি ও মৎস্য ব্যবসায়ী সাজিয়ে অবৈধ সম্পদকে বৈধ করার চেষ্টা করেন বলে মন্তব্য করেন সনাক-টিআইবি চট্টগ্রামের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, এসব দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি সম্পদগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এটি থেকে শিক্ষা নিয়ে যাতে ভবিষ্যতে অন্যরা ঘুষ–দুর্নীতিতে জড়িয়ে না পড়েন। না হলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকবে।

সূত্রঃ লইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ

Exit mobile version