প্রতিবেশীর সন্তানকে দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি

বাংলা নিউজ ডেস্কঃ প্রতিবেশীর সন্তানকে দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। প্রতিবেশীর সন্তান কোলে নিয়ে শিক্ষা অফিসে এসে আবেদন করে ছুটি নেন তিনি। বিষয়টি চাউর হলে শিক্ষিকা দাবি করেন কাগজপত্র দিয়ে শিক্ষা অফিস ম্যানেজ করে ছুটি নিয়েছেন। গত ৭ জুন সন্তান মারা গেছে বলেও জানান তিনি।

চোখ কপালে ওঠার মতো এই ঘটনা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর। উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের মুনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা তিনি। নাম আলেয়া সালমা শাপলা। সন্তান জন্ম না দিয়ে মাতৃকালিন ছুটি নিয়ে চলতি বছরের ১৪ মার্চ থেকে বগুড়ায় স্বামীর বাড়িতে আছেন তিনি।

অভিযোগ উঠেছে ধার করা সন্তান দেখিয়ে ‘ছুটি’ নেয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা কেয়া, উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ও হিসাবরক্ষক (বড়বাবু) আজিজার রহমান, সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আবু নোমান মো. নওশাদ আলীর যোগসাজশ রয়েছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জেনেও ব্যবস্থা নেননি। যদিও এসব অস্বীকার করেছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের পর ২০১৯ সালে তৃতীয় বিয়ে করেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলা কাগইল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শফি আহমেদ স্বপনকে। বিয়ের পর বগুড়ায় স্বামীর বাড়িতে যাওয়া পর দেশে করোনা মহামারী শুরু হলে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও তিনি অসুস্থ থাকাসহ নানা অজুহাতে ছুটি নিয়ে বগুড়ায় থেকে যান। মাঝেমধ্যে ছুটি নিতে ও অফিসিয়াল কাজে স্কুলে আসতেন।

এ অবস্থায় গত ১৩ মার্চ একটি শিশুকে কোলে নিয়ে নাগেশ্বরী উপজেলা শিক্ষা অফিসে উপস্থিত হন আলেয়া সালমা। কোলের সন্তানকে নিজের বলে মাতৃত্ব ছুটির আবেদন করেন। তারপর থেকে ছুটিতে তিনি।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষা অফিসে আসার সময় তার সঙ্গে এক নারী ছিলেন। নাম শারমীন বেগম। শিক্ষিকা আলেয়ার কোলের শিশুটি শারমিনের। শারমিন বগুড়ায় আলেয়ার বর্তমান স্বামীর প্রতিবেশী ও সম্পর্কের আত্মীয়। তার স্বামীর নাম আনিছুর রহমান পাশা। শিশুটি তাদের দ্বিতীয় সন্তান।

সরেজমিনে মুনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে জানা যায়, মাঝে-মধ্যে স্কুলে আসতেন শিক্ষিকা আলেয়া সালমা। কখনও তাকে সন্তানসম্ভবা দেখা যায়নি। অভিভাবক ফরিদুল ইসলাম ও আব্দুল মমিন জানান, তিনি কম আসতেন। মাঝেমধ্যে আসলেও তাকে কখনও গর্ভবতী দেখা যায়নি।

স্থানীয় ফরিদা বেগম বলেন, আলেয়া মাস্টারনীর ছোট শিশু দেখিনি আমরা। ওটা অন্য কারও সন্তান হবে। স্থানীয় লোকজন ও অভিভাবকদের দাবি, তিনি অন্যের সন্তান দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন। শিক্ষা অফিসের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত। প্রধান শিক্ষকও যোগসাজশে রয়েছে।

বিদ্যালয়ে কর্মরত অন্য শিক্ষকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নাগেশ্বরী থাকা অবস্থায় শিক্ষিকা আলেয়া প্রায়ই আসতেন। বিয়ে করে বগুড়া যাওয়ার পর তিনি আসেননি। সরাসরি অফিসে গিয়ে ছুটির আবেদন করেছেন তিনি। স্কুলে আসেননি। সন্তান হয়েছে শুধু শুনেছেন। দেখেননি তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া জেলার সারিন্দাকান্দি উপজেলার হাট শেরপুর ইউনিয়নের তাজুরপাড়া গ্রামের মৃত মন্টু সরদারের চতুর্থ মেয়ে আলেয়া সালমার প্রথম বিয়ে হয় একই ইউনিয়নের বলালী গ্রামের এক সেনাসদস্যের সঙ্গে। ২০০৬ সালে ওই সেনাসদস্য মারা যায়। এরপর মুঠোফোনে পরিচিত নাগেশ্বরী পৌর এলাকার বিদ্যুৎপাড়ার শহিদুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ের পর ২০১২ সালে শিক্ষকের চাকরি হয়। পরে নানা কারণে ২০১৬ সালে তাকে ডিভোর্স দেয় শহিদুল।

এরপরে বগুড়ায় বর্তমান স্বামী স্বপনের সঙ্গে বিয়ে হয়। আলেয়া সালমার ঘরে প্রথম দুটি ও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে একটি সন্তান রয়েছে। তবে শিক্ষা অফিসের তথ্যে দুই সন্তান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আলেয়া সালমার স্বামীর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার দ্বিতীয় স্বামীর সন্তানের বয়স আট বছর এবং সেটাই তার শেষ সন্তান। তিনি যে শিশুটিকে নিয়ে শিক্ষা অফিসে এসেছেন সেটি তাদের প্রতিবেশী আনিছুর রহমান পাশার। তার স্ত্রী শারমীনকে বেড়ানোর কথা বলে নাগেশ্বরীতে নিয়ে এসে শিশুটিকে অফিসে দেখায়।

এ বিষয়ে কথা হলে শারমিন জানান, ওনার (আলেয়া) সঙ্গে কুড়িগ্রামে বেড়াতে গেছিলাম। সেখানে আমার বাচ্চা তার বলেছে সেটা আমি কিভাবে বুঝবো। তার বড় মেয়ে আফিফার বয়স পাঁচ এবং ছোট মেয়ে আশফিয়ার এ বছরের মার্চে জন্ম বলেও জানান তিনি।

বগুড়ায় থাকা আলেয়া সালমা মুঠোফোনে জানান, এটা আমার ওপর ষড়যন্ত্র হয়েছে। সেখানে আমার বিয়ে হয়েছে। সেটা ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর এলাকায় বিয়ে হয়। করোনার সময় বাচ্চাটা পেটে আসে। এজন্য কেউ জানেন না। গত ৭ জুন তার মেয়ে সন্তানটি মারা গেছে বলেও জানান তিনি। তার সব কাগজ রেডি আছে চলতি মাসের ১৪ তারিখে ছুটি শেষে অফিসে জমা করবেন।

ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা কেয়া বলেন, তিনি তো এখানে থাকেন না। তার বাচ্চা হলো কি না হলো আমরা জানবো কেমন করে। দেখা তো নাই। ওই সময় সে বলেছিল তার পেটে বাচ্চা। ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়েছে। আমরা তো ডাক্তার না এর বেশি বলতে পারবো। তিনি অন্যায় করলে ডিপার্টমেন্ট ব্যবস্থা নেবে।

উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ও হিসাবরক্ষক (বড়বাবু) আজিজার রহমান বলেন, এটা তার এটিও ও হেডমাস্টার জানার কথা। অফিসে কাগজপত্র দিয়েছে ছুটি হয়েছে। ভেতরের খবর তো আমরা জানি না। তিনি গর্ভবতী হলে সহশিক্ষকরা জানার কথা। তারা কেন জানে না বুঝতেছি না।

ক্লাস্টারের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আবু নোমান মো. নওশাদ আলী বলেন, তাকে বিধি অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হয়েছে। তাকে সন্তানসম্ভাবা দেখেছেন কিনা বা জেনেছেন কিনা প্রশ্ন করল তিনি ফোন কেটে বন্ধ করে রাখেন।

নাগেশ্বরী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মোবাশ্বের আলী বলেন, স্বাভাবিক যে ছুটি দেয়া হয় সেভাবে ছুটি দিয়েছি। চিকিৎসকের কাগজপত্র, প্রধান শিক্ষক ও এটিও কাগজপত্র দিয়েছেন সে আলোকে ছুটি দেয়া হয়েছে। যদি তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা মো. শহিদুল ইসলাম জানান, কয়েকদিন আগে বিষয়টি জেনেছি। জানার পরই উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে বলেছি। প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a Reply