বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ শুধু রপ্তানিকারকদের

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে শুধু এ দেশের রপ্তানিকারকেরা। বিদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে আগ্রহী কোম্পানির রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) হিসাব থাকতে হবে এবং তাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে। রপ্তানিকারকেরা তাদের পাঁচ বছরের গড় রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ অথবা সর্বশেষ নিরীক্ষিত স্থিতিপত্রে (ব্যালান্স শিট) থাকা মোট সম্পদের ২৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবে।

এসব বিধিবিধান যুক্ত করে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের ‘বিদেশে বিনিয়োগ নীতিমালার’ খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খসড়া নীতিমালা সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আগামী গভর্নিং বোর্ডের সভায় এ নীতিমালা অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্ব করার কথা।

নীতিমালাটি হলে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়বে। এখন পর্যন্ত নীতিমালা না থাকার পরও বিশেষ বিবেচনায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আরও অনেকে এ সুযোগ পেতে আবেদন করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদেশে বিনিয়োগের নীতিমালা প্রণয়নবিষয়ক একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের জন্য বিডার নির্বাহী সদস্য অজিত কুমার পালকে সমন্বয়ক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি শুধু যোগ্যদের এ সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা করার কাজ শুরু করে।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম একাধিকবার প্রথম আলোকে বলেছেন, বাংলাদেশি বেশ কিছু কোম্পানির সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এ সক্ষমতা কাজে লাগাতে অন্যান্য বিষয় বিবেচনা সাপেক্ষে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের খসড়া নীতিমালায় কোন কোন প্রতিষ্ঠান যোগ্য বলে বিবেচিত হবে, তার কিছু মানদণ্ড ঠিক করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সময়ে রপ্তানি আয় ফেরত আনে না এবং আমদানির দেনা পরিশোধ করে না, এমন প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে না। ঋণ ও কর খেলাপিরাও এ সুযোগ পাবে না। এসব ক্ষেত্রে অতীত পরিষ্কার থাকতে হবে। আবেদনকারীর ঋণমান বা ক্রেডিট রেটিং বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাসেল-২ নীতিমালা অনুযায়ী কমপক্ষে দুই হতে হবে। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান এ দেশে যে ধরনের ব্যবসা করে, বিদেশে একই অথবা সহায়ক অথবা পরিপূরক ব্যবসার জন্য বিনিয়োগের আবেদন করতে পারবে।

খসড়া নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব লাভজনক বলে প্রমাণ করতে হবে এবং এই বিনিয়োগ দেশের আয় বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি ও দেশের মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে হবে। আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানে বৈশ্বিক বাণিজ্য, অর্থ ও বিনিয়োগের বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ থাকতে হবে। নীতিমালার খসড়ায় সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি ও যাদের সুরাহা না হওয়া পুনর্গঠিত বড় ঋণ আছে, তারা আবেদনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

কোন কোন দেশে বিনিয়োগের সুযোগ

বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কোন কোন দেশে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে, তারও একটি মাপকাঠি নির্দিষ্ট করা হয়েছে নীতিমালার খসড়ায়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার যেসব দেশের সঙ্গে বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা চুক্তি করেছে এবং যেসব দেশের সঙ্গে দ্বৈত কর প্রত্যাহার চুক্তি আছে, শুধু সেই সব দেশে বাংলাদেশিরা বিনিয়োগের অনুমতি পাবে। যেসব দেশ মূলধন, মুনাফা, কমিশন, পরামর্শ ও অন্যান্য মাশুল বাবদ অর্থ ফেরত নিতে দেয় না, সেই সব দেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হবে না। সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশিদের কাজের অনুমতি দেওয়া হয় কি না, বিনিয়োগের অনুমতি দিতে সে বিষয়টিও বিবেচনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আবেদনের প্রক্রিয়া

উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের জন্য আবেদন করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর। মাধ্যম হতে হবে ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের অথরাইজড ডিলার শাখা। আবেদনের সঙ্গে আবেদনকারীকে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে। খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, এ আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রতিবেদনসহ আবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের অবস্থা, পূর্বাভাস, লেনদেনের ভারসাম্য, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হবে। সরকারের সম্মতি পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগের অনুমতির চিঠি আবেদনকারীর ব্যাংকে পাঠিয়ে দেবে।

যারা আগ্রহী

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটা থেকে আটটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে আছে তৈরি পোশাক খাতের ডিবিএল গ্রুপ, যারা ইথিওপিয়ায় কারখানা করছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে মবিল যমুনা, যুক্তরাষ্ট্রে এসিআই হেলথ কেয়ার ও স্কয়ার ফার্মা, যুক্তরাজ্য ও এস্তোনিয়াতে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, কেনিয়ায় বিএসআরএম স্টিল ও সিঙ্গাপুরে স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। সর্বশেষ গত মাসে আকিজ গ্রুপকে মালয়েশিয়ায় দুটি কারখানা অধিগ্রহণের জন্য দুই কোটি ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন দেয় সরকার।

এ দেশের আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। এর মধ্যে হা-মীম গ্রুপ হাইতিতে পোশাক কারখানায়, নিটল-নিলয় গ্রুপ গাম্বিয়ায় ব্যাংকে, সামিট গ্রুপ সিঙ্গাপুরে শিপইয়ার্ডে, মেঘনা গ্রুপ কম্বোডিয়ায় ও ভারতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বিনিয়োগ করতে চায়। এদিকে নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি চীনে যৌথ বিনিয়োগে একটি কাচ উৎপাদনের কারখানা করেছে বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

Leave a Reply