বুয়েট গবেষকদের গবেষণাপত্রের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

বিভিন্ন সময় নানা ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করে এ দেশের মানুষ। আর এসব দুর্যোগের পর সমন্বয় এবং সুবিন্যস্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়ে। সম্প্রতি ত্রাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কয়েকজন গবেষক। তাঁদের তৈরি গাণিতিক মডেল, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি এবং এ-সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘আইট্রিপলই আর ১০ হিউম্যানিটেরিয়ান টেকনোলজি’ সম্মেলনে কমিউনিটি নিডস ও পরিবেশ বিভাগে সেরা গবেষণাপত্রের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই দলে রয়েছেন বুয়েটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান (তত্ত্বাবধায়ক), কম্পিউটার কৌশল বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির গবেষক সুজয় দাস এবং একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাদিয়া শারমিন।

ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্স—আইট্রিপলই হচ্ছে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস এবং কম্পিউটার প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন। পৃথিবীর ১৬০টি দেশে এই সংগঠনের প্রায় ৪ লাখ ২৩ হাজার সদস্য রয়েছেন। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেশাজীবী সংগঠন।

সুজয় দাস ‘ত্রাণ ও পুনর্বাসনের নেটওয়ার্ক’ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি জানান, দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসনের একটি নেটওয়ার্ক বা গাণিতিক মডেল নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এটি কীভাবে সুবিন্যস্ত করা যায় তা নিয়েই মূল কাজ। এর ফলে প্রান্তিক মানুষের কাছে সহজে ত্রাণ পৌঁছানো বা প্রাণ রক্ষা করা সুবিধা হবে। এ নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ‍উন্নয়ন করা সম্ভব। ইতিমধ্যে ‘হাত বাড়াই’ নামের একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছেন তাঁরা।

সুজয় দাসের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলায়। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী সাইক্লোন সিডরের ধ্বংসযজ্ঞ তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। সিডর-পরবর্তী সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমও তিনি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছেন। এসব পর্যবেক্ষণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সুবিন্যস্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি।

সুজয় দাস বলেন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন একটি বহু-অংশীদারি প্রক্রিয়া। দুর্যোগ-পরবর্তী যেকোনো ত্রাণ কার্যক্রমের সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, বেসরকারি সংস্থা, বহুজাতিক দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা, বন্ধুপ্রতিম বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তাদের বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা, স্থানীয় দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা, দানশীল ব্যক্তিবর্গসহ অনেকেই যুক্ত থাকেন। এই অংশীদারদের মধ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের নিরিখে স্বপ্রণোদিতভাবেই একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। এই নেটওয়ার্কটি গড়ে উঠলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সুসমন্বিত তথা কার্যকর হওয়ার পথ সুগম হয়।

সুজয় দাসের গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বুয়েটের অধ্যাপক মো. সাইদুর রহমান। তাঁর মতে, গ্রাফ ও নেটওয়ার্ক তত্ত্বের আলোকে সমস্যাটি সমাধানের কাজ শুরু হয়।

গবেষকেরা জানান, গবেষণা থেকে পাওয়া গাণিতিক মডেল অনুসরণ করে দুর্যোগ-পরবর্তী পরিবেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের আগাম তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের একটি সুবিন্যস্ত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব। এতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের কাঙ্ক্ষিত কার্যকারিতা নিশ্চিত করা অনেকাংশেই সহজ হয়। গাণিতিক মডেল অনুযায়ী তৈরি করা নেটওয়ার্কটি হবে একটি কমপ্লেক্স নেটওয়ার্ক যাতে স্মল ওয়ার্ল্ড ইফেক্ট ও হাই ক্লাস্টারিং কো-এফিসিয়েন্ট থাকে। কমপ্লেক্স নেটওয়ার্ক হচ্ছে বিশেষ ধরনের একটি নেটওয়ার্ক, যা কাঠামোগত সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। কয়েকটি প্রভাবশালী অংশীদারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই সুবিশাল নেটওয়ার্কের পুরোটাকেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্মল ওয়ার্ল্ড ইফেক্ট হলো খুব সহজে এবং কম ধাপে কোনো অংশীদারের অন্য যেকোনো অংশীদারের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারার নিশ্চয়তা এবং অপ্রয়োজনীয় সরাসরি সংযুক্তির সম্ভাবনা কমিয়ে দেওয়া। আর হাই ক্লাস্টারিং কো-এফিসিয়েন্ট হলো সমধর্মী অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক সংযুক্তির অধিকতর সম্ভাবনা। একটি সুসমন্বিত তথা কার্যকর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম এসব বিষয়ের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল বলে জানান গবেষক দলের আরেক সদস্য সাদিয়া শারমিন।

গবেষক দলের সদস্যরা মনে করেন, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও বিদ্যমান প্রযুক্তি উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত মানবমুক্তির পথ সুগম করা। অসহায় মানুষের পাশে লাগসই প্রযুক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণায় তাঁরা তাঁদের গবেষণাকর্ম নিয়ে আরও এগিয়ে নিতে চান।

Leave a Reply