
লাকসাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি:
লাকসামে যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লাকসাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার নার্গিস সুলতানা।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান।
এবং লাকসাম থানার নবাগত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাকসুদ আহাম্মদ, উপজেলা কৃষি অফিসার আল আমিন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার আহম্মদ উল্যাহ সবুজ এবং উপজেলা প্রকৌশলী সাদিকুল ইসলাম রিদান। লাকসাম উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিলন চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তারা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং তাঁদের অবদানের কথা তুলে ধরেন। বক্তারা বলেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এই আত্মত্যাগ কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তাঁরা।উক্ত অনুষ্ঠানে লাকসাম উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধারাও উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভায় তাঁরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা তুলে ধরেন। মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
আলোচনায় বক্তারা ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী চক্রের ভূমিকা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ, যার লক্ষ্য ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য ও মেধাশূন্য করে ফেলা। বক্তারা আরও বলেন, এই ঘাতক বাহিনীর সহযোগীরা ইতিহাসের ঘৃণ্য অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এক পরিকল্পিত জাতিধ্বংসের ইতিহাস
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। শিক্ষক, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান ব্যক্তিদের চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দেওয়া।
মিরপুর, রায়েরবাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গণকবরে তাঁদের নিথর দেহ পাওয়া যায়। বিজয়ের পর স্বজনেরা এসব বধ্যভূমিতে গিয়ে প্রিয়জনদের মরদেহ শনাক্ত করেন। এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস ও হৃদয়বিদারক অধ্যায়।
বিভিন্ন সূত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যায় মতভেদ রয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা প্রায় ১,০৭০ জন বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) অনুযায়ী ২৩২ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হলেও তালিকাটি অসম্পূর্ণ বলে স্বীকার করা হয়েছে।
২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ শব্দটির একটি আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা প্রদান করে। সংজ্ঞায় বলা হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে যেসব বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা হত্যা, গুম বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁরাই শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের মাধ্যমে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে সেইসব মহীরুহকে, যাঁদের রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস।
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে মেধা শূণ্য করার জন্য পাকিস্তানি সেনা জেরারেল রাও ফারমান আলী এদেশের বুদ্ধিজীবিদের হত্যার নেশায় মেতে উঠেন।
জেনারেল রাও ফারমান আলী ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ও বিতর্কিত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাঁর ভূমিকার কারণে।তিনি ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। ঢাকা শহরের সামরিক প্রশাসন ও গোয়েন্দা কার্যক্রমে তাঁর প্রভাব ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে সংঘটিত ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও তালিকা তৈরির সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত বলে বহু গবেষক ও সাক্ষ্যে উল্লেখ রয়েছে। একটি নোটবুকে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবীদের নাম পাওয়ার কথা বলা হয়, যা পরে হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ হিসেবে আলোচিত হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বুঝতে পারছিল যে তারা যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য ও মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী ব্যবহৃত হয়। যুদ্ধের পর রাও ফারমান আলী পাকিস্তানে ফিরে যান।বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত হলেও তিনি কোনো আন্তর্জাতিক বা স্থানীয় ট্রাইব্যুনালে শাস্তি ভোগ করেননি।

