বহু ট্রাভেল ব্যবসায়ী নিঃস্ব সাবেক সেনাসদস্যের ‘প্রতারণায়’

বাংলা নিউজ ডেস্কঃ রাজধানীর কল্যাণপুরের অরভী ওভারসীসের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ খালিকুজ্জামান হিরা। দীর্ঘদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকসহ নানা ভিসায় মানুষ পাঠান এবং সৌদি আরবে হজ যাত্রী পাঠান তিনি। সম্প্রতি সাবেক সেনাসদস্য ও অস্ট্রিলিয়ান নাগরিক এবং রাষ্ট্রপতির আত্মীয় পরিচয়ে আব্দুল আজিজ ওরফে রাসেল নামে এক ব্যক্তি হিরাকে জানান, দেশটিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে চান। হিরাসহ ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস অর্জনে আজিজ ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে এক কর্নেলের সঙ্গে মিটিং করেন। লেনদেনের চুক্তি শেষে ৫০টি ভিসা দেওয়ার নামে হিরার কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। কিন্তু পাসপোর্টে ভুয়া ভিসা দেওয়ায় কোনও শ্রমিক বিদেশে যেতে পারেননি। এতে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে দেখেন, আজিজ ও তার সহযোগীরা সবাই আত্মগোপনে চলে গেছে। শুধু হিরা নয়, আজিজের প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন বহু ট্রাভেল ব্যবসায়ী ও রিক্রুটিং এজেন্সি।’
এ ঘটনায় ডিএমপির রমনা থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন জনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন– আব্দুল আজিজ (৫৫), মো. নুরুল হুদা (৬৪) ও লুৎফর রহমান রতন (৪৮)। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাগজ, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্ট ও নকল সিল উদ্ধার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ সব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
প্রতারণার শিকার হিরা বলেন, ‘নিজেকে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ও সেনা বাহিনীর কর্মকর্তা পরিচয় দিতেন রাসেল। এছাড়া রাষ্ট্রপতির আত্মীয় পরিচয় দিয়ে কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ভিসা দেওয়ার কথা বলে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এমনকি তার প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে টাকা ফেরত চাইতে গেলে এ সব পরিচয় ব্যবহার করে আমাদের হুমকি ধমকি দেওয়া হতো। আর রাসেল অস্ট্রেলিয়ান নম্বর ব্যবহার করতেন। তিনি সরাসরি আমাদের সঙ্গে দেখা করতেন না, এজেন্টদের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন।’
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির গ্রামের বাড়ি পাবনায়। তারই এলাকার সাবেক সেনাসদস্য আব্দুল আজিজ নিজেকে রাষ্ট্রপতির আত্মীয় ও অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক পরিচয় দিতেন। বিদেশে চাকরির ভিসা দেওয়ার নামে বিভিন্ন ট্রাভেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি। আজিজের অন্যতম সহযোগী নুরুল হুদা। মাঠ পর্যায়ে তাদের হয়ে কাজ করেন ফারুক, তুহিন, সরোয়ারসহ বেশ কয়েকজন এজেন্ট। তারা বিভিন্ন ট্রাভেল ব্যবসায়ীকে ভিসা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেন। আজিজের কথিত গ্রামীণ ট্রাভেলসের মাধ্যমে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভিসা দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নিতো চক্রটি।’
তিনি বলেন, ‘নিজেকে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বিশ্বাস করাতে আজিজ অস্ট্রেলিয়ার একটি ফোন নম্বর ব্যবহার করে খোলা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। সবাইকে বলতেন তিনি অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন এবং নুরুল হুদা তার বাংলাদেশী প্রতিনিধি। ট্রাভেল ব্যবসায়ীরা তাকে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী হিসেবেই বিশ্বাস করতেন। তারা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা এনে আজিজের কাছে দিতেন ভিসা পাওয়ার আশায়। আজিজ তাদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিস গুটিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এ সব টাকা নিতে ব্যবহার করা ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয় ভুয়া এনআইডি কার্ড ও ঠিকানা দিয়ে। ফলে তাকে আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী সহজে খুঁজে পেতো না।’
ডিএমপির গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, ‘আজিজ ১৯৬৮ সালে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে সৈনিক পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ২০০৯ সালে সার্জেন্ট পদ থেকে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার পর রাজধানীর কাকরাইলে ভিশন-২০২০ নামে একটি ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। সেই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মানুষের থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এরপর ২০২০ সাল থেকে নুরুল হুদার সঙ্গে গ্রামীণ ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া-কানাডা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর কথা বলে প্রতারণার জাল বিস্তার করেন।’
তিনি বলেন, ‘তার দেশীয় কিছু সহযোগী বিভিন্ন এজেন্টদের কাছে গিয়ে গ্রামীণ ট্রাভেলসের মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দিতেন। ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া কোটি কোটি টাকা নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতেন আজিজ। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি ও নুরুল হুদার বিরুদ্ধে দুটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।’
বিদেশি নাগরিক কিংবা দেশের কোনও উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের পরিচয় ব্যবহার করে কেউ সুবিধা দেওয়ার কথা বললে যাচাই-বাছাইসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেনদেনের অনুরোধ জানান ডিএমপির এই পুলিশ কর্মকর্তা।

Leave a Reply