সিন্ডিকেটে এক রাতেই পিঁয়াজের দাম দ্বিগুণ

সিন্ডিকেটের কারণে ফের বেড়ে গেছে পিঁয়াজের দাম। ভারতের পিঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার খবর প্রকাশের পর থেকে লাফিয়ে বাড়ছে দাম। এক রাতের ব্যবধানে ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া দেশি পিঁয়াজ দ্বিগুণ দামে ২২০-২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতীয় পিঁয়াজ কেজিতে ৮০-৯০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২০০-২১০ টাকায়। এদিকে পিঁয়াজের দাম বেশি রাখায় সারা দেশে ১৩৩ ব্যবসায়ীকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ঘুরে পিঁয়াজের অস্বাভাবিক দামের চিত্র দেখা গেছে।

জানা গেছে, শুক্রবার থেকেই রাজধানীর বাজারগুলোতে পিঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তবে শুক্রবার ১২০ টাকা ধরে পিঁয়াজ কিনেছেন অনেকেই। আর গতকাল দেশি পিঁয়াজ ২১০ টাকার নিচে কোথাও পাওয়া যায়নি। কোথাও কোথাও কেজিতে দাম চেয়েছে ২৪০-২৫০ টাকা। রাজধানীর  মিরপুরের শাহ আলী মার্কেট, কারওয়ানবাজার, শ্যামবাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে দেখা  গেছে পিঁয়াজের ঊর্ধ্বমুখি দাম। খুচরা বিক্রেতারা জানান, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে পিঁয়াজের দাম। এ জন্য পাইকাররা দেশি পিঁয়াজ ছাড়ছেই না। যাত্রাবাড়ী পাইকারি বাজারে ভোরে যে দাম ছিল, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সকাল ৯টায় তা মণপ্রতি ৮০০-১০০০ টাকা বেড়েছে। বিকাল নাগাদ বাজারে পিঁয়াজের দাম আরও বেড়ে যায়।

রায়েরবাগ বাজারের বিক্রেতা আলি নূর বলেন, ভোরে শ্যামবাজার থেকে বহু কষ্টে দুই মণ ভারতীয় পিঁয়াজ এনেছি। পাইকারিতে কিনেছি ৭ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে। আনতে খরচ পড়ছে ৪০০-৪৫০ টাকা। এখন ২০০ টাকা কেজি বিক্রি না করলে লোকসান হবে।
শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী স্মৃতি বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, শ্যামবাজারে পাইকারিতে দেশি পিঁয়াজের মণ ৮ হাজার ৮০০ এবং ভারতীয় পিঁয়াজ ৭ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মূলত ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণায় দাম বেড়েছে। একদিন আগেও আমরা প্রতি কেজি পিঁয়াজ পাইকারিতে ১১০ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন সেটা ২২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে মুড়িকাটা পিঁয়াজ বাজারে সম্পূর্ণরূপে উঠলে কমতে পারে দাম বলেন ওই ব্যবসায়ী।

শ্যামবাজারের রাজিব বাণিজ্য ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী প্রদেশ পোদ্দার বলেন, ভারত সরকারের বেঁধে দেওয়া রপ্তানি মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলারেই বন্দর দিয়ে পিঁয়াজ আমদানি অব্যাহত ছিল। ভারতের পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কারণে দেশের পিঁয়াজ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তেমনি পিঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের দাবি জানান তিনি। রায়েরবাগে বাজার করতে আসা ক্রেতা হানিফ মোহাম্মদ বলেন, বাজারে দেশি পিঁয়াজ ২৪০ টাকা কেজির নিচে মিলছে না। আর ভারতের পিঁয়াজ ২০০ টাকা কেজি। দুই দিন আগেও দেশি পিঁয়াজ কিনলাম ১২০ টাকা করে। রাতের মধ্যেই বেড়ে গেল ১২০ টাকা। দেশি পিঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকা চাওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নিজেদের মন মতো করে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে, কোথাও মনিটরিং হচ্ছে না। এদিকে পিঁয়াজের দাম বেশি রাখায় সারা দেশের ১৩৩ ব্যবসায়ীকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সারা দেশে ভোক্তা অধিদফতরের ৫৭টি টিম এ অভিযান পরিচালনা করেন। ভোক্তা অধিকার রক্ষায় অধিদফতরের এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানান অধিদফতর।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় গতকাল দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের কোনো কোনো আড়ত থেকে উধাও হয়ে গেছে পিঁয়াজ। ব্যবসায়ীদের দাবি- দেশে পিঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তবে বাজার কারসাজিতে অস্থির দেশের পিঁয়াজের বাজার। খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ছৈয়দ ছগীর আহমদ বলেন, ভারত হঠাৎ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। পিঁয়াজের দামও বেড়ে চলেছে। বিকল্প দেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি শুরু হলে স্বাভাবিক হবে দাম।

তবে খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, গত আগস্ট মাসে ভারত সরকার পিঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিলে ব্যবসায়ীরা বিকল্প দেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি শুরু করে। এরই মধ্যে মিয়ানমার, পাকিস্তান, তুরস্ক, মিসর এবং চীন থেকে প্রচুর পিঁয়াজ আনেন আমদানিকারকরা। ফলে দেশে পিঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। শুক্রবার ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে এলে এটাকে অজুহাত হিসেবে নেয় কতিপয় আমদানিকারক। তারা ভারতের রপ্তানি বন্ধের অজুহাতে অস্থির করে তুলেছে বাজার। তাদের কারসাজির কারণে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পিঁয়াজ পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়।

চট্টগ্রাম সমুন্দ্রবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, গত জুলাই মাস থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ২ হাজার ৫১৭ মে. টন পিঁয়াজ আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৯১ মে. টন। বাকি পিঁয়াজ আনা হয়েছে চীন থেকে। জানা যায়, দেশের পিঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ৯০ জনের সংঘবদ্ধ চক্র। চট্টগ্রাম, টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ৪০ জন আমদানিকারক এবং ৫০ কমিশন এজেন্ট এই চক্রের সদস্য।

বৃহস্পতিবার খাতুনগঞ্জে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হয় পিঁয়াজ। শুক্রবার ভারতের পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবর ছড়িয়ে পড়লে অস্থির হয়ে ওঠে বাজার। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শুক্রবারেই সেঞ্চুরি হয় পিঁয়াজের দামে। আর গতকাল ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো দোকানে ‘পিঁয়াজ নেই’ এমন সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অস্থির হয়েছে বরিশালের পিঁয়াজের বাজারও। এক রাতের ব্যবধানে দাম দিগুণ বেড়েছে। সিলেটে পিঁয়াজের দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়েছে। রাজশাহীর বাজারেও অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে পিঁয়াজের দাম। পাইকারি বাজারে কেজিতে বেড়ে গেছে ৮০ টাকা পর্যন্ত, আর দেশিতে বেড়েছে ৬০ টাকা। বিক্রেতারা জানান, বাজারে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পিঁয়াজ নেই। যশোরের বেনাপোলে দুই দিনের ব্যবধানে বাজারে পিঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৮০ টাকা। এতে নিম্নআয়ের মানুষ পড়েছে বিপাকে। বেনাপোলের কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে ভারত থেকে ৫৫০ মেট্রিক টন পিঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। নাটোরের বাজারগুলোতে ১২০ টাকার পিঁয়াজ এক দিনের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। একই সঙ্গে ভারত থেকে আমদানি করা এবং নতুন ওঠা পিঁয়াজের দামও বেড়েছে। জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভুঁঞা জানান, একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে স্থানীয় বাজারে অভিযান শুরু হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে পিঁয়াজ বিক্রির দায়ে তিন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পাবনায় বাজারেও পিঁয়াজের দাম অস্থির হয়ে গেছে। গতকাল মুহূর্তেই ১০০ টাকা থেকে পিঁয়াজের দাম বেড়ে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ময়মনসিংহেও এক রাতের ব্যবধানে পিঁয়াজের দাম বেড়েছে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। গতকাল দিনভর পিঁয়াজের এমন অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি পেলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হতাশ সাধারণ মানুষ। রবিবার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ। বাগেরহাটে হু হু করে বাড়ছে পিঁয়াজের দাম। গতকাল সন্ধ্যায় খুচরা বাজারে ও আড়তে পাওয়া যাচ্ছে না দেশি পিঁয়াজ। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পাশাপশি বিপাকে পড়েছেন উচ্চবিত্ত ক্রেতারাও। রবিবার থেকে অভিযান পরিচালনার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালিদ হোসেন। ফেনী শহরের ইসলামপুর রোডে বেশি দামে পিঁয়াজ ও রসুন বিক্রি করার দায়ে তিন পাইকারি ব্যবসায়ীকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, নিজেদের বাজারে পিঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী মার্চ পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এর আগে বিরূপ আবহাওয়ায় ফলন ভালো না হওয়ায় ভারত নিজেদের বাজারে পিঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গত ২৯ অক্টোবর প্রতি টন পিঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দেয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। (দৈনিক বাংলা নিউজ অনলাইন)

Leave a Reply